দুর্দান্ত কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প
অগ্নিঝরা মার্চ মাস। আমাদের স্বাধীনতার মাস। এই মাসে আমাদের গৌরবের মাস। এই মাসে আমরা বিশেষভাবে স্মরণ করি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের। আজ এমন কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প বলবো যারা ছিলেন একটু ভিন্ন মাত্রার। এদের কেউ তখনো তাদের কৈশোর অতিক্রম করতে পারেন নি। এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু তাদের সাহস, দেশপ্রেম ও দেশমাতৃকার সম্মান ও স্বাধীনতা রক্ষার ব্যাপারে প্রচেষ্টা কোনটারই কমতি ছিল না।
অনন্য প্রত্যয়ী আবু সালেক
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উচ্চ বিদ্যালয়। এই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে আবু সালেক। এমন সময় শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। কে ঠেকায় আবু সালেককে? সীমানা পেরিয়ে চলে গেল আগরতলায়। সেখানে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই করা হচ্ছিল। কিন্তু ও তো একদম ছোট, বাচ্চা! ওকে কেউ-ই নিতে চাইল না। আর তাই শুনে ও তো একেবারে কান্নায় ভেঙে পড়ল। ওর কান্না দেখে ওকে আর বাদ দিতে পারলেন না দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসাররা। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম লেখালো ছোট্ট আবু সালেক।
আগরতলা থেকে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো মেলাঘর ক্যাম্পে। তারপর বড় বড় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শুরু করল যুদ্ধ; পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার যুদ্ধ। এমনি একদিন ওরা যুদ্ধ করছিল চন্দ্রপুর গ্রামে। আবু সালেক সেই যুদ্ধে ছিল বাংকারে। সে এক ভীষণ যুদ্ধ। প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছে। আর পাকবাহিনীও সেদিন ছিল সুবিধাজনক জায়গায়। আবু সালেকের দল তেমন একটা ভালো অবস্থানে নেই। এক পর্যায়ে ওদের পক্ষ টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে দাঁড়ালো। এখন ওদের সামনে একটাই রাস্তা, পিছু হটতে হবে। কিন্তু চাইলেই কি আর পিছু হটা যায়, একজনকে তো ব্যাকআপ দিতে হবে। নইলে যে সবাই মারা পড়বে। কে এই মরণফাঁদে পড়ে থেকে অনবরত গুলি করে শত্রুদের চোখে ধুলো দেবে, যাতে সেই ফাঁকে অন্যরা সরে যায় নিরাপদ জায়গায়?
এগিয়ে এলো একেবারে সবার ছোট আবু সালেক। ছোট্ট কাঁধে তুলে নিলো বিশাল এক দায়িত্ব। ক্রমাগত গুলি করতে লাগল পাকবাহিনীর ক্যাম্প লক্ষ্য করে। আর সেই অবসরে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে গেলো অন্যরা। ও কিন্তু গুলি করা থামাল না। এক সময় পাকআর্মিরা মনে করল, মুক্তিযোদ্ধারা মনে হয় খুব সংগঠিতভাবে আক্রমণ চালাচ্ছে। ফলে ওরাও পিছু হটে গেল। বাংকারে থেকে গেল শুধু আবু সালেক। একসময় রাত শেষ হয়ে সকাল হয়ে গেল। মুক্তিযোদ্ধারা ভেবেছিলো, গোলাগুলি যখন থেমেছে, আবু সালেক নিশ্চয়ই শহীদ হয়েছে। কিন্তু বাংকারে গিয়ে তো ওরা অবাক! কিশোর আবু সালেক একা সেখানে বসে আছে। দেখে ওরা যে কী খুশি হলো!
দুরন্ত মোজাম্মেল
মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হলো, মোজাম্মেল হক তখন মাত্র নবম শ্রেণীর ছাত্র। পড়তো ঢাকার স্টাফ ওয়েলফেয়ার হাইস্কুলে। যুদ্ধ শুরু হল আর মোজাম্মেল বাসায় বসে থাকবে, তা কি হয়? শরীরে যে তখন তারুণ্যের জোয়ার এসে গেছে! কুমিল্লা সীমান্ত পেরিয়ে ও চলে গেল মেলাঘর ক্যাম্পে। ছোট বলে ওকেও মুক্তিবাহিনীতে নিতে চাইল না ভারপ্রাপ্ত অফিসার। অনেক কষ্টে মোজাম্মেল মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিল। তারপর প্রশিক্ষণ শেষে চলে এল ঢাকায়, এম এ লতিফের গ্রুপের একজন গেরিলা হিসেবে যুদ্ধ শুরু করল।
মোজাম্মেলের আবার একটা মজা ছিলো। ওর চাচা আব্দুল জব্বার, মোনায়েম খাঁর বাড়িতে কাজ করতেন। চাচার সঙ্গে মিলে এক ভীষণ পরিকল্পনা আঁটতে লাগল ও। সখ্য গড়ে তুলল মোনায়েম খাঁর বাসার আরো দুই কাজের লোক শাহজাহান ও মোখলেসুর রহমানের সঙ্গে। অক্টোবর মাসে পর পর দুবার তার পরিকল্পনা ব্যর্থও হলো। কিন্তু কয়বার আর পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে পারে বলো? তৃতীয়বার ঠিকই কাজ হলো।
এবারের পরিকল্পনামাফিক এক সন্ধ্যায় মোজাম্মেল গেল মোনায়েম খাঁর বাসভবনে। মোনায়েম খাঁ ছিলেন ড্রয়িংরুমে। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল কেবল কৈশোর পেরুনো মোজাম্মেল। স্টেনগান বের করে তাক করলো মোনায়েম খাঁর দিকে। তারপর টিপে দিলো স্টেনগানের ঘোড়া।
পরদিন রেডিওতে খবর এল, মারা গেছে মোনায়েম খাঁ।
গ্রুপ কমান্ডার বাহাউদ্দিন
এই গল্পটিও এক নবম শ্রেণী পড়ুয়া কিশোরের। নাম তার বাহাউদ্দিন রেজা। বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। যুদ্ধ শুরু হলে বাহাউদ্দিনও যোগ দিল মুক্তিবাহিনীতে। তার অবশ্য মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে কোনো সমস্যা হয়নি। কারণ ও যে আগেই চৌদ্দগ্রাম থানা থেকে অস্ত্র লুট করে এনেছিল!
কাঁঠালিয়া ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে ও নেমে পড়ল যুদ্ধে। আটজনের একটি গ্রুপের গ্রুপ কমান্ডার ও নিজেই। ওদের টার্গেট- স্থানীয় কমার্স ব্যাংকে গেরিলা হামলা চালানো। একটা নৌকায় করে ওরা পার হলো গোমতী নদী। মাঝিও ওদেরই লোক। আটজনের দল ভাগ হয়ে গেলো চারটি ছোট দলে। প্রতি দলের একজনের কাছে শুধু গ্রেনেড, আরেকজনের কাছে পিস্তল আর গ্রেনেড। বাহাউদ্দিনের কাছে একটি পিস্তল আর দুটি গ্রেনেড।
সকাল সাড়ে দশটায় ওরা ঢুকলো কমার্স ব্যাংকে। বাহাউদ্দীন ঢুকেই ছুঁড়ে মারলো তার হাতের গ্রেনেডটি। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ হলো। কিন্তু ও নিজেও তো ব্যাংকের ভেতরে। স্প্রিন্টার এসে বিঁধলো ওর গায়েও। আহত হয়ে দ্রুত ব্যাংক থেকে বেরিয়ে পড়ল ও। পট্টি বেঁধে রক্ত ঝরা একরকম বন্ধ করে দৌড়োতে লাগলো খেয়াঘাটের দিকে।
কিন্তু বিধি বাম। রাস্তায় মুখোমুখি হয়ে গেলো এক রাজাকারের সঙ্গে। সে খবর পেয়েছে কমার্স ব্যাংকে বিস্ফোরণ ঘটেছে। আর বাহাউদ্দিনের শরীর থেকে রক্ত ঝরছে দেখে বলল, ও নিশ্চয়ই বোমা ফাটিয়েছে। বাহাউদ্দিন কিছুই বললো না, ঠাণ্ডা মাথায় পাশের ধানখেতে নেমে আঁজলা ভরে পানি দিলো মুখে। রাজাকারটার সন্দেহ তাতে আরো বেড়ে গেল। এগিয়ে এসে কলার ধরে বসল। আর যায় কোথায়, এক লাথিতে রাজাকারটাকে ধান ক্ষেতে ফেলে দিল বাহাউদ্দিন। তারপর পকেট থেকে পিস্তল বের করেই দুম!
এরপর আবার ছুট। একছুটে খেয়াঘাটে। আবারও রাজাকারের সামনে পড়তে চায় না বাহাউদ্দিন। মাঝিও তাড়াতাড়ি ওকে গোমতী পার করে পৌঁছে দিল হাসপাতালে। আর সেই হাসপাতাল পরিদর্শনে সেদিন কে এসেছিলেন জানো? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু, ভারতের সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সব শুনে তো তিনি যাকে বলে রীতিমতো হতভম্ব! এইটুকুন একটা ছেলে, সে কিনা এত্তো বড়ো একটা কাণ্ড ঘটিয়ে এসেছে!
ক্ষুদে বীরউত্তম জহিরুল
এবারের গল্পটা জহিরুলের। একাত্তর সালে ওর বয়স মোটে সতেরো বছর। তবু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ও যোগ দিলো মুক্তিবাহিনীতে। প্রথমে কুকিতলা ক্যাম্পে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিল। আর সাড়ে তিন মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলো রীতিমতো সেনা কর্মকর্তা হয়েই।
জহিরুল যুদ্ধ করছিলো ৪ নম্বর সেক্টরে। এবার ওকে যুদ্ধ করতে হবে কানাইঘাটে। অঞ্চলটা পাকিস্তান বাহিনীর দখলে। কিন্তু কানাইঘাট তো আর ওদের দখলে রাখা যাবে না। কারণ, এই পথ দিয়েই অগ্রসর হবে জেড ফোর্স। সুতরাং, দখল করতে হবে কানাইঘাট।
রাত তিনটায় ওর দলের সাথে কানাইঘাটে এসে পৌঁছলো জহিরুল। পূর্বমুখে অবস্থান নিলেন জহিরুল। শুরু হলো ভীষণ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে জিততেই হবে। আর কোনো পথ নেই। নইলে যে জেড ফোর্স এ পথ দিয়ে যেতে পারবে না। ওদের সবার মুখে একই সুর- হয় জিতবো, নয়তো সবাই শহীদ হবো। তবু এ লড়াই হারা যাবে না।
শেষমেশ যুদ্ধে ঠিকই জয় হলো মুক্তিবাহিনীর। যাদের বুকে অটুট দেশপ্রেম, তারা কী আর যুদ্ধে হারতে পারে বলো? আর শুধু এই যুদ্ধে না, জহিরুল বীরত্ব দেখিয়েছিলো ওর দলের সবগুলো যুদ্ধেই। আর তাই তো ওকে রীতিমতো বীরউত্তম খেতাব দেওয়া হয়েছে।
ভয়ংকর হালু
এবার শোনাবো এক খেতাব না পাওয়া কিশোর মুক্তিযোদ্ধার গল্প। নাম তার হালু। একাত্তরে যুদ্ধের সময় ওর বয়স ষোল কি সতেরো। বয়স কম হলে কি হবে, এরই মধ্যে ও এলাকার রাজাকার- আলবদর- আলশামসদের কাছে রীতিমতো ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। যোগ দিয়েছে ভয়ংকর কাদেরিয়া বাহিনীতে। প্রায়ই খবর পাওয়া যেতো বিভিন্ন অপারেশনে কিভাবে হালু গণ্ডা গণ্ডা রাজাকার- আল বদরদের একাই মেরে ফেলেছে। এজন্য অবশ্য ওর বাবা-মা আর বোনকেও অনেক প্যারা সহ্য করতে হতো।
একদিন শোনা গেলো, এক বিরাট অপারেশনে মারা গেছে হালু। তবে এমনি এমনিই মরেনি ও, মরার আগে একাই ১০-১২ জন পাকহানাদারকে খতম করে গেছে। শুনে তো ওর বাবা-মা-বোন কান্নায় ভেঙে পড়লো। কিন্তু দুদিন বাদে হালু গভীর রাতে বাসায় হাজির! দেখে তো সবাই হতবাক! আসলে ঘটনা কী, ওর বাবা-মা-বোনকে যাতে কোনো সমস্যা পোহাতে না হয়, সেজন্য হালুই বুদ্ধি করে ওর মৃত্যুর মিথ্যা খবর রটিয়ে দিয়েছিল!
১৬ ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। পাকবাহিনীর হালুয়া টাইট অবস্থা। কবে আত্মসমর্পণ করবে, তারই অপেক্ষা কেবল। এমনি একদিন হালু ফিরে এল তার এলাকায়। বাজারে চায়ের দোকানে বসে বেশ জমিয়ে আড্ডাও দিলো। তারপর রওয়ানা দিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু রাত গভীর থেকে আরো গভীর হয়, হালু আর বাড়ি যায় না। রাত দশটার দিকে স্কুলের দিক থেকে কিছু গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে এলো। পরদিন সবাই গিয়ে দেখে, স্কুলের পাশের ধানক্ষেতে অনেকগুলো লাশ, সবই স্থানীয় রাজাকারদের। কিন্তু হালুর লাশও নেই, কোনো খবরও নেই। কোথায় গেলো অসম সাহসী হালু?
না, কিশোর মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকারদের কাছে ভয়ংকর এক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত হালুকে আর পাওয়া যায়নি। তার মৃতদেহও পাওয়া যায়নি। সেদিন রাতে রাজাকারদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে অল্পের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারল না ভয়ংকর এই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা।
এমনি কতো নাম-জানা আর নাম-না-জানা কিশোর মুক্তিযোদ্ধার সাহসিকতা আর বীরত্বের গল্পগাঁথা জড়িয়ে আছে আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে! স্বাধীনতার মাসে সব মুক্তিযোদ্ধাকে সালাম। আপনাদের অসীম সাহসীকতায় আজ আমরা বাংলাদেশী।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.