মানুষের মাংশ খাওয়া এক স্বৈরশাসকের কাহিনী
পৃথিবীজুড়ে ভিন্ন স্বভাবের অনেক মানুষই আছেন। কিন্তু এদের মধ্যে এমন একজন ছিলেন যাকে মানুষ হিসেবেই গণ্য করা হয় না। যার ভয়ঙ্কর রুপ ও নিষ্ঠুরতার কাহিনী শুনলে আজো মানুষের বুক কাঁপে। তিনি হলেন ‘দ্য বুচার অব উগান্ডা’ খ্যাত উগান্ডার সাবেক স্বৈরশাসক ইদি আমিন। বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও নিষ্ঠুর শাসক হিসেবে তাকে গণ্য করা হয়। নিষ্ঠুরতার এক পর্যায়ে মানুষের মাংশ খাওয়া শুরু করেন এই স্বৈরশাসক।
এই ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন মানুষের উপর এতো নির্যাতন করেছেন, যার বর্ণনা শুনলে আজও মানুষ শিউরে উঠে। তার শাসনামলে প্রায় ৬ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। তিনি ফ্রিজে মানুষের কাটা মাথা ও অন্যান্য অংঙ্গ মজুদ রাখতেন। মানুষের মাংস খাওয়ার নেশা ছিল তার। এসব নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের কারণে তাকে ‘ ম্যাড ম্যান অব আফ্রিকা’ বলেও ডাকা হয়।
সাবেক এই স্বৈরশাষক ইদি আমিন নিষ্ঠুরতার সব সীমা অতিক্রম করেছেন। সে তার দেশের সুন্দর মেয়েদের ধর্ষণ করতেন এবং তাদের কোনো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করতেন না। তাদের জীবিত কবর দিতেন এবং কুমিরকে খাওয়াতেন। ১৯৭৯ সালে তাঞ্জানিয়া এবং আমিন বিরোধী উগান্ডার সেনা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এরপর আমিন পালিয়ে সৌদি আরবে চলে যান। সেখানে ২০০৩ সালে তার মৃত্যু হয়।
ইদি আমিনের উত্থান
গরীব পরিবারে জন্মগ্রহণ করা ইদি আমিন প্রাথমিক শিক্ষা কতটুকু লাভ করেছিলেন, সে সম্বন্ধে বিতর্ক আছে। তবে বাল্যকালেই যে সংসারের অভাবমোচনের কাজে নেমে পড়েছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ১৯৪৬ সালে ২১ বছর বয়সী আমিন যোগ দেন কেএআর তথা কিংস আফ্রিকান রাইফেলস-এ। এই কেএআর হচ্ছে ব্রিটিশদের আফ্রিকান ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনী। আমিন এই সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন বার্মা, সোমালিয়া, উগান্ডা আর কেনিয়ায় কাজ করেছেন। মাউ মাউ বিদ্রোহীদের দমনের কাজে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
কেকেআরে ইদি আমিন
কেনিয়ার মাউ মাউ বিদ্রোহীদের দমনের সময় ইদি আমিনের শক্তিশালী ভূমিকাই মূলত তার পদোন্নতি ত্বরান্বিত করেছিল। ১৯৫১ সালে যিনি হয়েছিলেন একজন সাধারণ সার্জেন্ট। মাত্র দশ বছরের ব্যবধানে তিনি ১৯৬১ সালে লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হন। ১৯৬২ সালে উগান্ডা এবং কানাডার দুটি আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে গবাদি পশু নিয়ে বিবাদ ও দাঙ্গার সৃষ্টি হলে, ইদি আমিন সেখানে গণহত্যা চালান। তার এই নিষ্ঠুর দমনকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আখ্যা দিয়ে তৎকালীন উগান্ডার প্রধানমন্ত্রী অ্যাপোলো মিল্টন ওবোতের কাছে তার বিচারের দাবি জানায় তার একসময়কার সমর্থক ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তারা!
কিন্তু শীঘ্রই ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেতে যাওয়া উগান্ডার প্রধানমন্ত্রী ওবোতে হিতে বিপরীত হবার ভয়ে আমিনকে শাস্তি তো দিলেনই না, বরং তাকে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত করলেন! পরের বছর ১৯৬৩ সালে ইদি আমিন হয়ে গেলেন মেজর। এরপর ব্রিটেনের উইল্টশায়ারের কয়েকটি সেনা ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দিয়ে ইদি আমিন কর্নেল পদে উন্নীত হলেন। সেই থেকে আমিন-ওবোতে বন্ধুত্ব শুরু হয়। এই বন্ধুত্বের ধারাবাহিকতায় ইদি আমিন ১৯৬৬ সালে ‘চিফ অব স্টাফ’ এবং পরের বছর মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন।
ক্ষমতা গ্রহণ
তিনি ওবোতের সাথে বন্ধুত্বের সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের সামরিক ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধি করতে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, ওবোতের অগোচরে তিনি ব্রিটিশ ও ইসরায়েলি গুপ্তচরদের সাথেও হাত মেলান। তবে তার এই বিশ্বাসঘাতকতার খবর পেয়ে যান ওবোতের। প্রথমে তিনি আমিনকে গৃহবন্দী করেন। কিন্তু ততদিনে আমিনের বেশ প্রভাব ও সেনাবাহিনীতে একটা সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। ফলে তাকে গৃহবন্দী রাখা সম্ভব হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে ওবোতে আমিনকে মুক্ত করে দেন এবং একটি অ-প্রসাশনিক পদে নিয়োগ করেন। ইদি আমিন সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। অবশেষে সেই সুযোগ এলো ১৯৭১ সালের ২৫ জানুয়ারি। ওবোতে তখন রাষ্ট্রীয় সফরে সিঙ্গাপুর ছিলেন। আমিন এই সুযোগে ক্যু করলেন এবং দেশের ক্ষমতা দখল করে নিলেন। ক্ষমতা দখল করেই নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন।
বর্বরতা ও দুঃশাসন
শুরুর দিকে ইদি আমিনকে উগান্ডার জনগণ ত্রাণকর্তাই মনে করতো। কিন্তু অল্প কিছুদিন পর যখন তার আসল চেহারা প্রকাশিত হয় তখন খুব দ্রুতই তার বিরুদ্ধে গ্ণজাগরণ গড়ে উঠে। ইদি আমিনের সরকার সর্বপ্রথম যুক্তরাজ্যের সমর্থন অর্জন করেন,যেহেতু পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট ওবোতে কমিউনিস্টপন্থী ছিলেন। প্রেসিডেন্ট আমিন ছিলেন খুবই হামবড়া স্বভাবের। তিনি নিজেকে তাবৎ পশু ও সমুদ্রের মৎসকুলের অধিশ্বর বলে দাবী করতেন। প্রথমিক শিক্ষা শেষ না করেই আমিন নিজেকে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী হিসেবে দাবী করতেন। ক্ষমতায় এসে ইদি আমিন বাণিজ্যের উপর স্বদেশের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করার সিদ্বান্ত নেন। এর আগে ভারতীয়রা এবং ব্রিটিশরা উগান্ডার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রন করতো। আমিন ভারতীয়দের এবং ব্রিটিশদের উগান্ডা ত্যাগে বাধ্য করেন। হঠাৎ বণিক বনে যাওয়া উগান্ডিয়ানদের বাণিজ্যে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল খুবই কম। তাই উগান্ডার পণ্যা সরবরাহ ব্যাবস্থা ধসে পড়ে।
ট্রেডিশনাল নাচে অংশ নিলেন ইদি আমিন
ইদি আমিনের ক্ষমতা গ্রহণের পর ওবোতে তানজানিয়াতে পালিয়ে যান। সেখান থেকে ১৯৭২ সালে তিনি নিজের সমর্থকদের নিয়ে একটি ক্যু করার চেষ্টা চালান। তার ক্যুয়ের সমর্থনে উগান্ডার সেনাবাহিনীর একটি অংশ ছাড়াও তানজানিয়ার আচোলি এবং ল্যাঙ্গো সম্প্রদায়ের সামরিক কর্মকতারাও যোগ দেন। কিন্তু ক্যু ব্যর্থ হয়। আমিন সেই সামরিক কর্মকতাদের ঘরবাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেন। পাশাপাশি উগান্ডার সেনাবাহিনী থেকে তিনি আচোলি এবং ল্যাঙ্গো সম্প্রদায়ের লোকজনকে ছাঁটাই করতে শুরু করেন। ফলে সেনাবাহিনীর মধ্যে শুরু হয় বর্ণবাদী এক দাঙ্গা, যা ধীরে ধীরে উগান্ডার সাধারণ জনগণের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।
ইদি আমিনের খুন করা মানুষের খুলির সারি
এই বর্ণবাদী দাঙ্গার সময়ই ইদি আমিনের বীভৎস রূপ প্রকাশ পায়। তিনি নীল নদের তীরের ‘নাইল ম্যানসন’ এবং হোটেলগুলো সব দখল করে নিজের জিজ্ঞাসাবাদ ও টর্চার সেলে রূপান্তর করেন। দ্রুত সময়ে টর্চার সেলগুলো থেকে রক্তের স্রোত বয়ে যায় নীল নদে। কেবল দাঙ্গা চলাকালীন এই টর্চার সেলগুলোতে ইদি আমিনের অনুগত বাহিনী দশ হাজারের অধিক মানুষ হত্যা করে! এই বাহিনীর দুটি শাখা হচ্ছে ‘স্টেট রিসার্চ ব্যুরো’ এবং ‘পাবলিক সেফটি ইউনিট’। ইদি আমিনের সরাসরি নির্দেশে এ সময় হত্যা করা হয় ‘আর্চবিশপ অব উগান্ডা’ জানানি লুয়ামকে, উগান্ডার বিচারপতি, ম্যাকারেরে কলেজের উপাচার্য, উগান্ডার রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের গভর্নর সহ ওবোতের অনেক সাবেক মন্ত্রীকে। ধারণা করা হয় প্রায় ৬ লাখ মানুষকে সে হত্যা করে। মানুষের মাংস খাওয়া, ধর্ষণ ও বিচিত্রভাবে নারীদের খুন করা তার বর্বরতায় নতুন মাত্রা যোগ করে।
ইদি আমিনের পতন
১৯৭৮ এর অক্টোবরের শুরুর দিকে কাম্পালাতে ওবোতের অনুসারীরা আমিনের বাসভবন আক্রমণ করে। আমিন হেলিকপ্টারে করে সপরিবারে পালিয়ে রক্ষা পান। এদিকে আমিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মুস্তাফা আর্দ্রিসি সন্দেহজনক গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হন। আর্দ্রিসির অণুগত সৈন্যরা বিদ্রোহ করল। আমিনের সৈন্যরা বিদ্রোহ দমন করল। মুস্তাফা আর্দ্রিসির কিছু সৈন্য তানজানিয়াতে পালিয়ে গেল। বিদ্রোহ তানজানিয়াতে ছড়িয়ে পড়লো। আর্দ্রিসির সৈন্যরা ওবোতের সৈন্যদের সাথে মিলিত হয়ে আমিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল।
আমিন তানজানিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। উগান্ডার সরকারি বাহিনী তানজানিয়ার কাগারা অঞ্চলের বিরোধপূর্ণ জায়গা দখল করে নিল। জুলিয়াস নায়ারে তানজানিয়ার পিপলস ডিফেন্স ফোরসকে উগান্ডার আর্মির বিরুদ্ধে মোতায়েন করেন। কয়েক সপ্তাহের ভিতর ৪০০০০ নিয়মিত সৈনিকের সাথে ৬০০০০ পুলিশ,মিলিসিয়া,কারারক্ষী যোগ দেন। উগান্ডার আমিন বিরোধীরা উগান্ডান ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি গঠন করে নায়ারের সাথে যোগ দেন।
রাশিয়ান বিএম কাতুস্কা দিয়ে তানজানিয়ানরা উগান্ডার সেনাদের উপর গোলা বর্ষণ করে। উগান্ডা সেনাবাহিনী পিছিয়ে যায়। লিবিয়ার মুয়াম্মর আল-গাদ্দাফি ২৫০০ সৈন্য, টি ৫৪, টি ৫৫ ট্যাংক, মিগ ২১, টু ২২ বিমান ও গোলা বারুদ দিয়ে সাহায্য করেন। কিন্তু লিবিয়ানরা খুব দ্রুত টের পায় তারাই সম্মুখ যুদ্ধ করছে এবং উগান্ডান সেনারা পরিবহন ট্রাক দিয়ে তানজানিয়া থেকে লুটের মাল উগান্ডাতে নিয়ে যাচ্ছে।
তানজানিয়া ও উগান্ডার বিদ্রোহীরা কাম্পালা অভিমুখে যাত্রা করে কিন্তু লুকাইয়া অঞ্চলে জলাভূমির কারণে থেমে যায়। তানজানিয়ার ২০১ তম ব্রিগেড জলাভূমি পাড়ির সিদ্ধান্ত নেয়। ২০৮ তম জলাভূমির পশ্চিম দিক দিয়ে বিকল্প পথে অগ্রসর হয়। কিন্তু ১৯৭৯ এর ১০ মার্চ লিবিয়ানদের একটি ব্রিগেডের সাথে সংঘর্ষে ২০১ তম ব্রিগেড পিছু হটে। অল্পসময় পরই ২০১ ব্রিগেড সুসংঘটিত হয়। তারা দক্ষিণ ও ২০৮ ব্রিগেড উত্তর দিক দিয়ে ১১-১২ তারিখের রাতে লিবিয়ানদের উপর হামলা করে। লিবিয়ানদের প্রতিরোধ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। ওই দিন ২০০ লিবিয়ান ও ২০০ উগান্ডার সরকারি সৈন্য নিহত হয়।
১০ই এপ্রিল ১৯৭৯। তানজানিয়া ও উগান্ডার বিদ্রোহীদের হাতে এন্তেবে বিমানবন্দর এবং রাজধানী কাম্পালার পতন ঘটে। সেখানে লিবিয়ান ও উগান্ডার সরকারি সৈন্যদের প্রবল প্রতিরোধ সত্ত্বেও তানজানিয়ানদের বিজয় ঘটে। আমিন প্রথমে লিবিয়া পরে সৌদি আরব পালিয়ে যান। লিবিয়ান আর্মি পিছু হটে। উগান্ডার নির্বাচন পর্যন্ত তানজানিয়ার সেনারা সেখানে ছিল। শেষ হয় ইদি আমিনের শাসন।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.