ভাষা আন্দোলনের তিন পর্যায়
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৫২ সাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এ সালটি চরম উৎকর্ষ বা সফলতার বছর। এ বছরের একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীগণ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করলে সরকারের পুলিশ বাহিনী মিছিলে গুলীবর্ষণ করে। ফলে কয়েকজন ছাত্র-জনতা গুলীবিদ্ধ হয় এবং এর ফলে আন্দোলন সফলতা অর্জন করে। এভাবে আন্দোলন ও চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি লাভ করে। তবে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় অনেক আগে। অনেকের ধারণা, ১৯৪৭ সালে কায়দে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ্র ঢাকা সফর এবং ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে তাঁর বিতর্কিত ভাষণ থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। এটা অংশত সত্য। ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও এ সময় থেকে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়নি, মূলত বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আমাদের ভাষা-সচেতনতা তথা রাজনৈতিক সচেতনতা থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।
১৯০৫ সালে প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে ইংরেজ শাসক পূর্ববাংলা ও আসাম অঞ্চল নিয়ে ‘বঙ্গাসাম’ নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করেন। এ নতুন প্রদেশের রাজধানী স্থাপিত হয় ঢাকায়। এ নতুন প্রদেশ গঠনের ফলে বাংলা দ্বিখ-িত হয়, কলকাতার প্রাধান্য অংশত ক্ষুণ্ণ হয়ে ঢাকা-কেন্দ্রিক নতুন উন্নয়নের প্রক্রিয়া সূচিত হয়। তাছাড়া, বঙ্গাসাম গঠিত হওয়ায় বাঙালি মুসলমানের সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, যাতায়াত ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত হয়। ফলে বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য কলকাতার হিন্দু বাবু-সম্প্রদায় প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। ক্রমান্বয়ে অবিভক্ত বাংলা এমনকি, নবগঠিত বঙ্গাসাম প্রদেশের রাজধানী ঢাকাসহ সকল এলাকার হিন্দু জমিদার-জোতদার-জায়গীরদার, শিল্পপতি-ব্যবসায়ী, উকিল-মোক্তার-চাকরীজীবী সকলেই এ আন্দোলনে বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় কবি-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ঐক্যবদ্ধভাবে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে তৎপর হয়ে ওঠেন। এ আন্দোলনে প্রধান নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ও বিশ্বখ্যাত কবি ও বাংলার অন্যতম প্রধান জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁদের নেতৃত্বে ও কায়েমী স্বার্থবাদী হিন্দু বাবু-সম্প্রদায়ের সম্মিলিত তৎপরতায় বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন ক্রমশ ভারতব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় কংগ্রেস পার্টি ও এর নেতা মোহন চাঁদ, করম চাঁদ, গান্ধী ও প-িত জওয়াহের লাল নেহরুও বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন সমর্থন করেন। অবশেষে ইংরেজ সম্রাট পঞ্চম জর্জ ১৯১১ সালে দিল্লী আগমন করলে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা তাঁকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা প্রদান করে। এ সংবর্ধনা উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবে ইংরেজ রাজার প্রশস্তি গেয়ে তাঁর বিখ্যাত ‘জয়, জয়, জয় হে, ভারত-ভাগ্য বিধাতা’ নামক গানটি রচনা করেন এবং সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তা গীত হয়। এভাবে রাজার মনোতোষের ব্যবস্থা করে হিন্দু নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গ রদের ব্যাপারে ইংল্যান্ড-রাজের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেন। ফলে, রাজা তাঁর উক্ত সফরকালেই বঙ্গভঙ্গ রদের আদেশ জারী করেন। এভাবে বাঙালি মুসলিম-স্বার্থ বিপন্ন হওয়ার সাথে সাথে ঢাকা-কেন্দ্রীক বাংলা ভাষা-সাহিত্য বিকাশের সম্ভাবনাও নস্যাৎ হয়ে যায়।
বঙ্গাসাম গঠিত হবার পরই এর বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায় ষড়যন্ত্র শুরু করে। ফলে মুসলমানরাও স্বীয় অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার শাহবাগ এলাকায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত সম্মেলনে ‘মুসলিম লীগ’ গঠন করেন। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হবার ফলে মুসলমানদের আশাভঙ্গ ঘটে। তাদেরকে সান্ত¡না দেয়ার উদ্দেশ্যে ইংরেজ সরকার ও মুসলিম সমাজকর্মীগণ ক্রমান্বয়ে ঢাকাতে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল স্কুল, কারিগরী স্কুল ইত্যাদি স্থাপনের ওয়াদা করেন। এরই প্রেক্ষাপটে ১৯১১ সালে রংপুরে অনষ্ঠিত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ির জমিদার নবাব আলী চৌধুরী সর্বপ্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানান। বাংলা ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত মূলত ঐ সময় থেকেই। তখন থেকেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা বা শিক্ষার মাধ্যম করার ক্ষেত্রে শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে লক্ষণীয় সচেতনতা সৃষ্টি হয়। অবশ্য স্বল্প সংখ্যক মুসলমান উর্দুর সপক্ষে কিংবা আরবি হরফে বাংলা লেখার পক্ষে কখনো-সখনো কথা বলেছেন বটে কিন্তু বৃহত্তর শিক্ষিত মুসলিম সমাজ কিংবা নেতৃস্থানীয় মুসলমান কেউ তাদেরকে সমর্থন করেননি। অন্যদিকে, বাঙালি হিন্দুসমাজ বাংলা ভাষার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত ছিল। এমন কি, বাংলা ভাষায় নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এক্ষেত্রে বাংলার দাবীকে জলাঞ্জলী দিয়ে হিন্দীর পক্ষ অবলম্বন করেন। ভারতের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের মতামত চেয়ে সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতা মোহন চাঁদ করম চাঁদ গান্ধীর লেখা চিঠির জবাবে রবীন্দ্রনাথ লিখিতভাবে হিন্দীর পক্ষে তাঁর মত প্রকাশ করেন। বিশিষ্ট প-িত ও ভাষাবিদ ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ শীর্ষ স্থানীয় হিন্দু মনীষীগণ হিন্দির পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেন।
মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে হিন্দীর পক্ষে রবীন্দ্রনাথ ও ডক্টর সুনীতীকুমারসহ বিশিষ্ট হিন্দু মনীষীগণ দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করা সত্তে¦ও বাঙালি হিন্দু-সমাজে এর কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়নি। ফলে তারা রবীন্দ্রনাথের মত সমর্থন করেন বলেই ধরে নেয়া যায়। কিন্তু বাঙালি মুসলমানরা নবাব আলী চৌধুরী, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ও ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে বাংলা ভাষার সপক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। ১৯১৮ সালে বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় সম্মেলনে বহু ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (তখনো ডক্টর হননি) হিন্দী ভাষার উপর বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে বলেনঃ “শুধু ভারত কেন, সমগ্র এশিয়া মহাদেশেই বাংলা ভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চ ভাব-সম্পদ ও সাহিত্য-গুণে বাংলা ভাষা এশিয়ার ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে অদ্বিতীয়।”
ডক্টর সুনীতিকুমারসহ সম্মেলনে উপস্থিত হিন্দু পণ্ডিতবর্গ এতে রুষ্ট হন এবং অনেকেই এর প্রতিবাদ করেন। ১৯১৯ সালে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বঙ্গীয় সম্মেলনে উপস্থিত মুসলিম প্রতিনিধিগণ বাংলা ভাষার পক্ষে তাঁদের সুস্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করেন। ১৯২১ সালে নবাব আলী চৌধুরী পুনরায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানিয়ে বলেনঃ “ভারতের রাষ্ট্রভাষা যাই হোক, বাংলার রাষ্ট্রভাষা করতে হবে বাংলাকে।”
১৯৩৭ সালে মওলানা আকরম খাঁ দৈনিক আজাদের সম্পাদকীয় কলামে লেখেনঃ “সাহিত্যের মধ্যে বাংলা সমস্ত প্রাদেশিক ভাষার (সাহিত্যের) মধ্যে শ্রেষ্ঠ। বাংলা ভাষার বিবিধ ভাব প্রকাশোয়োগী শব্দের সংখ্যাও বেশী। অতএব বাংলা সবদিক দিয়াই ভারতের রাষ্ট্রভাষা হইবার দাবী করিতে পারে। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস হিন্দীকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করিবার প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছে বটে, কিন্তু এ বিষয়ে বাংলা ভাষার চেয়ে হিন্দীর যোগ্যতা কোন দিক দিয়াই বেশী নহে।”
১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ কর্তৃক ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হবার কিছুদিন পর কলকাতায় ‘মুসলিম রেনেসাঁ সোসাইটি’ এবং ঢাকায় ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’ নামে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। এ দু’টি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানায়। ১৯৪৩ সালে ঢাকাস্থ সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের (পরে ডক্টর) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানায়। বাংলা ১৩৫০ সনের (ইং ১৯৪৪) কার্তিক সংখ্যা মাসিক মোহাম্মদীতে বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ লিখিত ‘পূর্ব পাকিস্তানের জবান’ শীর্ষক প্রবন্ধে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে অকাট্য যুক্তি প্রদর্শন করা হয়। অনুরূপভাবে ১৯৪৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির সম্মেলনে ইতিহাস শাখার সভাপতি আবদুল মওদুদ (পরে বিচারপতি) বলেনঃ “পশ্চিম ও উত্তর ভারতে যেমন ভাষা বিজ্ঞানে মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ অবদান উর্দু ভাষা, সেই রকম পূর্ব ভারতে মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে বাংলা ভাষা।”
১৯৪৫ সালের ৫ নভেম্বর কলকাতার বেকার হোস্টেলে অনুষ্ঠিত এক ভোজসভায় ‘আমরা কোন পথে?’ শীর্ষক নিবন্ধে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী হাসান জামান (পরে ডক্টর) বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম এবং রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানান। ঐ সময় কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে Bengali Literary Association গঠন করা হয়। উক্ত প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও বাংলাকে সমাজের সর্বস্তরে চালু করার চেষ্টা করা হয়। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমদ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর তীব্র প্রতিবাদ করে ১৯৪৭ সালের ২৯ জুলাই দৈনিক আজাদে লেখেনঃ
“... উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষারূপে গণ্য হইলে তাহা শুধু পশ্চাতগমনই হইবে।... যদি বিদেশী ভাষা বলিয়া ইংরাজি ভাষা পরিত্যক্ত হয়, তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ না করার পক্ষে কোন যুক্তি নাই।... যদি বাংলা ভাষার অতিরিক্ত রাষ্ট্রভাষা গ্রহণ করিতে হয়, তবে উর্দু ভাষার দাবী বিবেচনা করা কর্তব্য।... পাকিস্তান ডোমিনিয়নের অধিকাংশ অধিবাসীর মাতৃভাষা বাংলা এবং বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধিশালী সুতরাং পাকিস্তানে ভাষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাটি শ্রেষ্ঠ। ... পূর্ব পাকিস্তানের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দী ভাষা গ্রহণ করা হইলে, ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতার নামান্তর হইবে। ডক্টর জিয়াউদ্দীন আহমদ পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহনরূপে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষার সপক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন, আমি একজন শিক্ষাবিদ রূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি।”
এভাবে ‘লাহোর প্রস্তাব’ গ্রহণের পর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পূর্বেই বাঙালি মুসলমানদের নিকট পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তান শুধু স্বপ্ন-কল্পনার বিষয় ছিল না। এ স্বপ্ন-কল্পনার ভিত্তিতেই বাঙালি মুসলমানগণ তাদের ভবিষ্যৎ আশা-আকাক্সক্ষার ভিৎ রচনা করেন। মুসলমানদের স্বতন্ত্র, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তখন তাদেরকে সম্পূর্ণ আছন্ন করে রেখেছিল। এ স্বতন্ত্র, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের সাথে সেদিন মাতৃভাষা বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম, আদালতের ভাষা ও রাষ্ট্রভাষা করার স্বপ্নও অবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাই পাকিস্তান-পূর্বকালেই সাংবাদিক মুজীবুর রহমান খাঁ রচিত ‘পাকিস্তান’, লেখক-রাজনীতিবিদ হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী রচিত ‘পাকিস্তান’, সাংবাদিক তালেবুর রহমান রচিত ‘পাকিস্তানের ক্রমবিকাশ ও সর্বহারাদের পাকিস্তান’ গ্রন্থসমূহে এবং ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, কবি ফররুখ আহমদ, আব্দুল হক, মাহবুব জামাল জাহেদী প্রমুখের লেখায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানানো হয়। তাই বাংলা ভাষার আন্দোলন বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় পর্যন্ত বাঙালি মুসলমানের অস্তিত্ব ও ভবিষ্যত সম্ভাবনার স্বপ্ন-কল্পনার সাথে একান্ত অবিমিশ্র হয়ে পড়ে।
কিন্তু ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানদের স্বতন্ত্র, স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলেও মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ক্ষেত্রে টালবাহানা পরিলক্ষিত হয়। ফলে এ সময় থেকে ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ে বাংলা ভাষা দাবির সপক্ষে বাঙালি মুসলমানদের প্রতিপক্ষ ছিল হিন্দী ভাষী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায় আর দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রতিপক্ষ হলো উর্দু ভাষী, প্রতিক্রিয়াশীল কায়েমী স্বার্থপর ও গণবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। দুর্ভাগ্যবশত এ প্রতিক্রিয়াশীল চক্রটি ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত কায়েমী স্বার্থপর গোষ্ঠী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ভাষা আন্দোলনের এ পর্যায়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত কয়েকটি সিদ্ধান্তের ফলে এ আন্দোলন ক্রমান্বয়ে দানা বেঁধে ওঠে। কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষায় বাংলা ভাষাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা, ডাক টিকেট, স্ট্যাম্প, রেলগাড়ির টিকেট ইত্যাদিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার না থাকায় এ আন্দোলন গড়ে ওঠে।
বাংলা ভাষাকে এভাবে উপেক্ষা করার প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে ‘তমদ্দুন মজলিশ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। ভাষা আন্দোলনের পথিকৃত হিসাবে তমদ্দুন মজলিশ ও আবুল কাসেমের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত। ১৯৪৭ সালের ১ অক্টোবর তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের তরুণ অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়াকে (পরে ডক্টর) পরিষদের প্রথম আহ্বায়ক মনোনীত করা হয়। এ পরিষদের নেতৃত্বে ক্রমাগত আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সময় পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন শামসুল আলম। বৈঠকে আলাপ-আলোচনা ও তুমুল বাক-বিতণ্ডার পর মুখ্যমন্ত্রী ও সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে আট দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ আট দফার মধ্যে ৩ ও ৪ নং দফায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার মাধ্যম করার সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল।
ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সকল পরিসমাপ্তি ঘটে এখানেই। কিন্তু এর কয়েক দিন পরই ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ও মুসলিম লীগের সভাপতি কায়দে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফরে এসে ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ লোকের বিশাল সমাবেশে ঘোষণা করেন ‘Urdu and urdu shall be the state language of Pakistan’ এ সময় তিনি বাংলা ভাষার দাবীকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন। ফলে সমাবেশে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। শ্রোতাদের একাংশের মধ্যে প্রতিবাদের গুঞ্জরণ শুরু হয়। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে জিন্নাহ্ সাহেব তাঁর পূর্বঘোষণার পুনরুক্তি করেন। ঐ সময়ও ছাত্ররা তাঁর কথার প্রতিবাদ করেন। ঐদিন সন্ধ্যায় শামসুল আলমের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিবৃন্দ তাঁর সঙ্গে দেখা করলে তিনি তাঁর পূর্ব সিদ্ধান্তে অনঢ় থাকেন। তবে তিনি নিয়মিতান্ত্রিকভাবে প্রতিনিধি দলকে তাদের দাবী বাস্তবায়নে অগ্রসর হবার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ’My boys, two men may differ on point, let us differ respectfully. You can go with your point, with constitutional way. Any unconstitutional movement will be crushed ruthlessly”
কায়দে আযমের শেষোক্ত বক্তব্যে একটা সমঝোতার ইঙ্গিত ছিল। তাছাড়া, ১৯৪৮ সালের ৯ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে পূর্বোক্ত আট-দফা চুক্তির সাত দফার সপক্ষে প্রস্তাব পাশ হওয়ায় সকলেই আশান্বিত হয় এবং এটাকে আন্দোলনের সফলতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ফলে দীর্ঘ তিন বছরাধিককাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। ইতঃমধ্যে প্রতি বছর ১৫ মার্চ ‘ভাষা দিবস’ হিসাবে পালিত হতে থাকে।
১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খাঁ রাওয়ালপিন্ডিতে এক জনসভায় বক্তৃতাদানরত অবস্থায় আততায়ীর গুলীতে নিহত হওয়ার পর খাজা নাজিমুদ্দীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে প্রদত্ত ভাষণে কায়দে আযমের কথার প্রতিধ্বনি করেন। তাঁর এ ভাষণের পরই ঢাকা শহরে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। সভা-শোভাযাত্রা-বিক্ষোভ-ধর্মঘটে ক্রমান্বয়ে সারা দেশে টাল-মাটাল অবস্থার সৃষ্টি হয়। ভাষা আন্দোলনের তৃতীয় ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের সূত্রপাত এখানেই। এ পর্যায়ে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি পুনর্গঠিত হয়। চল্লিশ সদস্য বিশিষ্ট এ কমিটির অন্যান্য সদস্যগণ হলেনঃ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, আতাউর রহামন খান, আব্দুল হালিম, শামসুল হক, অধ্যাপক আব্দুল গফুর, কমরুদ্দীন আহমদ, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন, আবদুল আউয়াল, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, শামসুল হক চৌধুরী, খালেক নেওয়াজ, মুজিবুল হক, শামসুল আলম, আব্দুল মতীন, আখতার উদ্দীন আহমদ (পরে ব্যারিস্টার) প্রমুখ।
উক্ত সংগ্রাম কমিটির আহ্বানে সারাদেশে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের এক পর্যায়ে ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলীতে সর্বমেট ষাট জন হতাহত হলে ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত ও মর্মান্তিক পরিণতি ঘটে। ২১ ফেব্রুয়ারির জের ধরে সারাদেশে হরতাল-মিছিল, সভা-শোভাযাত্রা, বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে ছাত্র-জনতা সরকারের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে। এ গণরোষ উপেক্ষা করা সরকার তথা কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। ফলে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী মেনে নেয়া ছাড়া সরকারের গত্যন্তর ছিল না।
ভাষা আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া ছিল ব্যাপক ও সুদূর প্রসারী। আমাদের রাজনীতি-অর্থনীতি, ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এর দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়া অনুভূত হয়। ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের ভরাডুবির জন্য ভাষা আন্দোলনই মুখ্যত দায়ী। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণ-পরিষদ কর্তৃক শাসনতন্ত্রে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়া হয়। কিন্তু তা সত্তে¦¡ও ভাষা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে যে সচেতনতা, অধিকারবোধ ও স্বাধিকার চেতনা জাগ্রত করে তারই চূড়ান্ত পরিণতি হিসাবে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয়-দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও তার চূড়ান্ত পরিণতি হিসাবে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় বাংলা ভাষা স্বাভাবিকভাবে আমাদের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। বাংলা ভাষা বাংলাদেশের বাইরেও বিপুলসংখ্যক মানুষের মুখের ভাষা, কিন্তু এটি একমাত্র বাংলাদেশেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় অভিষিক্ত। এ মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করে। এ মহান আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ৩০তম কনফারেন্সে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষিত হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে।
ঢাকা এখন শুধু স্বাধীন বাংলাদেশেরই রাজধানী নয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চারও এক মহিমান্বিত আসন—বাংলাভাষী শতকরা আশিজন লোকের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চার স্বাধীন, অবারিত ক্ষেত্র। আমাদের জীবনের রসে, জীবনবোধ ও ঐতিহ্য-ইতিহাসের আলোকে নতুন শতাব্দীতে তা আরো দীপ্তময় হয়ে উঠবে। ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় স্মৃতি ও ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আমাদেরকে উত্তরোত্তর নব নব প্রেরণায় উজ্জীবিত করে তুলবে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.