উত্তাল ঊনসত্তরের সেই দুরন্ত কিশোরের গল্প
তৎকালীন মতিঝিল ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনির এক দুরন্ত ছেলের গল্প বলছি। তার নাম মতিউর রহমান মল্লিক। পুরান ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার ইন্সটিটিউটে ছেলেটা পড়তো। ক্লাস টেন। বয়স ১৬। দিনগুলো কি ভয়ানক টালমাটাল। দৃশ্যপট যেনো দ্রুতই পাল্টে যাচ্ছে। কান পাতলেই শুধু স্লোগানের ধ্বনি।
মাত্র ষোল বছর বয়সের এক কিশোর। নবম শ্রেণি পাশ করে সবে দশম শ্রেণিতে উঠেছে। পুরোনো ঢাকার বকশিবাজারে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী স্কুল নবকুমার ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র সে। মা-বাবার কাছে শুধু মতি। তার বাবা আজহার আলি মল্লিক স্বল্প বেতনের এক ব্যাংক-কর্মচারি। বেশ টানাটানির সংসার। এমনই এক সাধারণ পরিবারের সন্তান হয়েও মতিউরের নাম আজ ইতিহাসের সোনালি পাতায় উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা। আমরা তাকে স্মরণ করি পরম ভালবাসা, শ্রদ্ধা আর গৌরবের সাথে। সেদিনের সেই মতি বা মতিউর রহমান আজ শহীদ মতিউর নামেই সবার কাছে পরিচিত। বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে মিশে আছে তার নাম। পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে যে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে সেই সংগ্রামের এক পর্যায়ে কিশোর মতিউরের সাহস ও আত্মত্যাগ চলমান আন্দোলন-সংগ্রামকে আরও বেগবান করে। আরও প্রসারিত করে। আজ সাহসী ও দেশপ্রেমিক কিশোর মতিউরের সেই কাহিনিই বলবো আপনাদের কাছে।
মতিউরের জন্ম ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি, ঢাকায়। তার জন্মের এগারো মাস আগে ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর পাকিস্তানি পুলিশ গুলি চালায়। এতে শহীদ হয় বেশ ক’জন। বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের অন্যায় আচরণ, বৈষম্য এবং নিপীড়ন এর পরেও চলতে থাকে। আর তাদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের আন্দোলন-সংগ্রামও ক্রমশ জোরদার হতে থাকে। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ৬-দফা আন্দোলন, ৬৮-এর আগরতলা মামলা বিরোধী আন্দোলন এবং ৬৯-এর গণ-আন্দোলন ও পরবর্তীতে সর্বাত্মক গণ-অভ্যুত্থান ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বাঙালিদের পর্যায়ক্রমিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। এসব আন্দোলনের প্রতিটিই ছিল বাঙালিদের স্বার্থের পক্ষে, যা পাকিস্তানি শাসকেরা শক্তি দিয়ে দমন করতে চাইল।
এক পর্যায়ে ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের পক্ষে দলটির সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান (পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির পিতা) ৬-দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলেন। এই ৬-দফা কর্মসূচি ছিল বাঙালি স্বার্থের পক্ষে এক ঐতিহাসিক সনদ। বাঙালিদের সবক্ষেত্রে সমান অধিকার পাওয়ার নিশ্চয়তা সম্বলিত দাবিনামা। ৬-দফা ঘোষণার পর পাকিস্তানের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খান ভীষণ ক্ষেপে গেলেন এবং শেখ মুজিবকে দমন তথা বাঙালির ন্যায্য অধিকারকে পদদলিত করার লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। মিথ্যে অভিযোগে মুজিবসহ অন্যদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। তাঁকে এবং অন্য সহযোগীদের গ্রেফতার করে জেলে দেয়া হলো। প্রেসিডেন্ট আইয়ূবের মূল লক্ষ্য ছিল মুজিবকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলানো, তাহলে তার পথের কাঁটা দূর হয়। কিন্তু এদেশের মানুষ তা হতে দেয়নি। বিশেষ করে ছাত্রদের তুমুল আন্দোলনের মুখে শাসকের মসনদ কেঁপে উঠলো। ছাত্রদের এই আন্দোলনে স্লোগান উঠলো: জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো। তোমার আমার ঠিকানা—পদ্মা মেঘনা যমুনা ইত্যাদি।
এভাবে আন্দোলন এগিয়ে যায়। আসে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাস। আন্দোলনের উত্তাল জোয়ার রুখতে আরও মরিয়া হয়ে ওঠে আইয়ূবের সরকার। দেশের এই টালমাটাল অবস্থায় মতিউর চুপ করে থাকতে পারলো না। টগবগে তরুণ মতিউর এখন অনেক সচেতন। বাঙালিদের প্রতি আইয়ূব সরকারের বৈষম্য আর দমন-পীড়নের ঘটনা মতিউরকে দগ্ধ করে, ক্ষুব্ধ করে। তার ভেতরে ঘৃণা আর প্রতিবাদের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলে। এক সময় সেও একাত্ম হয়ে যায় আন্দোলন-সংগ্রামের সাথে। মিটিং-মিছিলে যোগ দিতে থাকে বড়দের সাথে। প্রায়ই মিছিলের সামনের সারিতে দেখা যায় তাকে।
২০ জানুয়ারি ১৪৪ ধারা অর্থাত্ কারফিউ ভেঙে ছাত্ররা মিছিল বের করলে পুলিশ মিছিলে গুলি চালায়। এতে শহীদ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র আসাদুজ্জামান আসাদ। মতিউরও ছিল সেই মিছিলে। নিজের দেশের পুলিশ কী নৃশংসভাবে গুলি চালিয়ে পাখির মতো নিজের দেশের মানুষ মারতে পারে সেই মর্মান্তিক দৃশ্য খুব কাছে থেকেই দেখেছিল মতিউর। এই ঘটনায় সে ভীত বা আতঙ্কিত হয়নি বরং তার মধ্যে প্রতিবাদী মনোভাব আরও জোরালো হয়। পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের প্রতি তার ঘৃণা আরও তীব্র হয়। সে যেন রাতারাতি হয়ে ওঠে আন্দোলনের এক লড়াকু সৈনিক। পড়াশোনায় মনোযোগী ছাত্র মতিউর বইপত্র শিকেয় তুলে আন্দোলনের কাফেলায় শামিল হলো। সারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আসাদ হত্যার ঘটনায় প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এই নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে ২৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে হরতাল ডাকা হয়। ঢাকার রাজপথ সেদিন মিছিলে মিছিলে উত্তাল। ২৪ জানুয়ারি ছিল মতিউরের জন্মদিন। কিন্তু সেদিকে তাকাবার তার সময় কোথায়! সে যোগ দেয় বিক্ষোভ মিছিলে। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার মিছিল চলছে। মুখে তাদের নানা স্লোগান। আকাশ-বাতাস কাঁপানো প্রতিবাদ আর বিক্ষোভের অগ্নিঝরা ধ্বনি। এই দুর্বার গণ-অভ্যুত্থান আইয়ূবের চামচাদের একেবারেই ভাল লাগেনি। পুলিশ গুলি চালায় মিছিলে। আর তাতেই শহীদ হয় কিশোর মতিউর। গুলিতে ঝরে পড়ে আরও ক’টি তাজা প্রাণ। এই নৃশংস ঘটনা যেন জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢেলে দিলো। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ক্ষোভ আর প্রতিবাদ-প্রতিরোধ এতই তীব্র হয়ে উঠলো যে স্বৈরশাসক আইয়ূব খানের ক্ষমতার মসনদ বালির বাঁধের মতো ভেঙে পড়লো।
ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিশোর সৈনিক শহীদ মতিউরের রক্ত বৃথা যায়নি। তার রক্তের ধারা বেয়েই ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান তুঙ্গস্পশী হয়, আর তারই পরিণতিতে স্বৈরাচারী আইয়ূবের ক্ষমতার অবসান ঘটে। এর পরেই আসে সত্তরের নির্বাচন, নির্বাচনে বাঙালির বিজয়, ক্ষমতা হস্তান্তরে পরবর্তী স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খানের নানা ছলচাতুরি, প্রতারণা এবং সবশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম। সুতরাং কিশোর শহীদ মতিউর শুধু ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানেরই এক অদম্য প্রেরণাশক্তি নয় বাঙালির মহান মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসেও তার আত্মদান চিরদিন অম্লান থাকবে। শহীদ মতিউর কিশোর-তরুণদের কাছে সাহস আর শক্তির প্রতীক। কিশোর-তরুণেরাও যে দেশের জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, নির্ভয়ে জীবন দিতে পারে—সাহসী মতিউর সে দৃষ্টান্ত রেখে গেছে আমাদের জন্য। এর ধারাবাহিকতায় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধেও তারা সে দৃষ্টান্ত অক্ষুণ্ন রাখে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.