উচ্চশিক্ষিত বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও চাকরি জীবন
১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ২০ বছর বয়সে বঙ্কিমচন্দ্র যশোরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। এই যশোরে অবস্থানকালেই বিখ্যাত ‘নীলদর্পণ’ নাটক রচয়িতা নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম পরিচয় হয়। এই পরিচয়ক্রমে ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়েছিল। যশোরে থাকাকালে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে বঙ্কিমচন্দ্রের স্ত্রী মোহিনী দেবী মারা যান। মৃত্যুকালে তার স্ত্রীর বয়স হয়েছিল মাত্র ১৫ বছর। বঙ্কিমের বয়স তখনও ২১ বছর পেরোয়নি।
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে জুন মাসে হালিশহরের বিখ্যাত চৌধুরী বাড়ির মেয়ে রাজলক্ষ্মী দেবীর সঙ্গে বঙ্কিম চন্দ্রের বিয়ে হয়। বিয়ের পর ১২ বছর বয়সের স্ত্রী রাজলক্ষ্মীকে নিয়ে তার কর্মস্থল নেগুয়ায় আসেন। এই চাকরি জীবনে মেদিনীপুরের নেগুয়াতে অবস্থানকালেই সমুদ্র ও অরণ্যের সৌন্দর্য দর্শনে তাঁর মনে বিখ্যাত রোমান্টিক উপন্যাস ‘কপাল কুন্ডলা’ রচনার অনুপ্রেরণা জন্মায়।
১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ললিতা’ ও ‘মানস’ প্রকাশিত হয়। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম সার্থক উপন্যাস ‘দুর্গেশ নন্দিনী’ প্রকাশিত হলে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। তার সম্পাদনায় ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ‘বঙ্গদর্শন’ নামে একখানা উন্নতমানের সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। বঙ্কিম চন্দ্রের উপন্যাসগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- দুর্গেশ নন্দিনী, কপাল কুণ্ডলা, মৃণালীনি, বিষবৃক্ষ, ইন্দিরা, যুগলাঙ্গুরীয়, চন্দ্রশেখর, রাধা রাণী, কৃষ্ণকান্তের উইল, রাজসিংহ, আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী, সীতারাম প্রভৃতি। উপন্যাস ছাড়াও ললিতা, লোকরহস্য, বিজ্ঞান রহস্য, কমলা কান্তের দপ্তর, বিবিধ সমালোচনা, দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী, কবিতা পুস্তুক, প্রবন্ধ পুস্তক, মুচিরামগুড়ের জীবন চরিত, বিবিধ প্রবন্ধ, ধর্মতত্ব, কৃষ্ণ চরিত্র, সহজ রচনা শিক্ষা, সংখ্যা দর্শন, বঙ্গ দেশের কৃষক, শ্রী মদ্ভগবদগীতা প্রভৃতি অজস্র বিচিত্র সাহিত্যমন্ডিত জ্ঞানগর্ভ সাহিত্য সম্ভারে বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন। বঙ্কিম চন্দ্রের এ যাবত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৪।
১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে বঙ্কিম চন্দ্র মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে বদলী হন। বহরমপুরে তিনি প্রায় ৪ বছর অবস্থান করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু দীনবন্ধু মিত্রের মৃত্যু ঘটেছিল ১৮৭৩ সালের ১লা নবেম্বর। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে এই অকাল মৃত্যুতে বঙ্কিমচন্দ্র খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন, ডাক বিভাগের একজন দক্ষ দায়িত্বশীল কর্মী হয়েও কর্তৃপক্ষের অবিচারের ফলে দীনবন্ধুর চাকরিতে পদোন্নতি হয় নাই। সে কারণেই দীন বন্ধুকে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
বঙ্কিমচন্দ্র, ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে বিভাগীয় কমিশনারের পিএ এবং ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে অস্থায়ীভাবে আলিপুরে বদলী হন। এ সময় তার প্রথম শ্রেণির ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদে প্রমোশন হয়। কর্মময় জীবনে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিম চন্দ্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সভ্য হন। তাঁর মতো একজন প্রতিভাবান, দক্ষ, নীতিবান ব্যক্তিকে ৩৩ বছর চাকরি করার পরও সেই ম্যাজিস্ট্রেটের একই পদ মর্যাদা নিয়ে কর্মজীবন শেষ করতে হয়ছে। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চাকরি করে অত্যন্ত অসুস্থ শরীর নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র অবসর নেন। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র তার দীর্ঘ একনিষ্ঠ কর্মজীবনের স্বীকৃতি হিসেবে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক রায় বাহাদুর ও সিআইই (কম্পোনিয়ান অব দি ইন্ডিয়ান এম্পায়ার) উপাধি প্রাপ্ত হন।
বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ডায়বেটিক রোগে আক্রান্ত হয়ে ৮ এপ্রিল বেলা ৩টা ২৫ মিনিটের সময় পঞ্চান্ন বছর ন’মাস বয়সে মারা যান। এভাবে বাংলা সাহিত্যাকাশের এক অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন ঘটলো।
বঙ্কিম চন্দ্রের কোন ছেলে ছিল না। তাঁর ছিল ৩ মেয়ে শরৎ কুমারী, নীলাব্জ কুমারী ও উৎপল কুমারী। বড়দা শ্যামা চরণের ছেলে কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর মুখাগ্নি করেন। বঙ্কিম চন্দ্রের বিধবা স্ত্রী রাজলক্ষ্মী দেবী তার মৃত্যুর পরেও দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন।
উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী বঙ্কিম চন্দ্র দেশাত্মবোধ ও স্বাজাত্যবোধের পুরোধা ছিলেন। তার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নব চেতনায় উদ্দীপিত বাঙালী সমাজ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তাই “ঋষি বঙ্কিম” বাঙালীদের দেওয়া তার স্বার্থক উপাধি।
তথ্যসূত্র :
বঙ্কিমচন্দ্র : কানাইলাল রায়
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.