বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উচ্চশিক্ষা
পন্ডিত ভবানী চরণ বিদ্যাভূষণের দৌহিত্র ও যাদব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগনা জেলার নৈহাটি জংশন স্টেশনের নিকটবর্তী কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা ছিলেন দুর্গা দেবী। বঙ্কিমের পিতা ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় সুশিক্ষা লাভ করে ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরি লাভ করেন এবং স্বীয় কর্মদক্ষতার গুণে অবশেষে ডেপুটি কালেক্টরের পদ লাভ করেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে গ্রামের ৫ বছরের একটি বালিকার সঙ্গে বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
অনেক ক্ষেত্রে পিতার মহত্ব ও বৈশিষ্ট্যের ছাপ পড়ে সন্তানের উপর। বঙ্কিম চন্দ্র সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা যাদব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইংরেজ সরকারের ডেপুটি কালেক্টর পদে কৃতিত্বের সাথে বহাল ছিলেন। পরে ইংরেজ সরকার তার কাজে খুশি হয়ে তাকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট করে দিয়েছিলেন। সেকালে ভারতীয়দের পক্ষে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদটি পাওয়া খুব সহজ ছিল না। সরকারের অত্যন্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত না হলে এ পদ পাওয়া যেতো না। বঙ্কিমেরা ছিলেন ৪ ভাই। বঙ্কিম ছিলেন সেজ। বড় ভাইয়ের নাম শ্যামাচরণ, মেজভাই সঞ্জীব চন্দ্র ও ছোট ভাই ছিলেন পূর্ণ চন্দ্র। বঙ্কিমের বড় ভাই শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়ও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হতে পেরেছিলেন। বঙ্কিমের মেজ ভাই সঞ্জীব চন্দ্রও হন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বঙ্কিম চন্দ্রের ছোট ভাই পূর্ণ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। সুনীল কুমার বসূ তার বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুস্তকে লিখেছেন ‘একই পরিবারে এতগুলো ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সদস্য দেখা যায় না। সেদিনের বিদেশি শাসনের যুগে ভারতীয়রা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চেয়ে উচ্চতর পদ পাওয়ার আশা করতে পারতো না।
১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিম চন্দ্রের বয়স যখন ৬ বছর তখন তিনি মেদিনীপুরে ইংরেজী স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৫ বছর বঙ্কিম চন্দ্র মেদিনীপুর ইংরেজী স্কুলের ছাত্র ছিলেন।
মেদিনীপুর থেকে কাঁঠালপাড়ায় ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই সেকালের বাল্য বিবাহের রীতি অনুযায়ী ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে কাঁঠাল পাড়ারই কাছে নারায়ণপুর গ্রামের ৫ বছর বয়সের মেয়ে মোহিনী দেবীর সঙ্গে বঙ্কিম চন্দ্রের বিয়ে হয়। সাড়ে এগারো বছর বয়সে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অক্টোবর বঙ্কিম চন্দ্র হুগলী কলেজে ভর্তি হন। তখনকার দিনে এখনকার মত এসএসসি, এইচএসসি ও বিএ পরীক্ষার প্রবর্তন হয়নি। ছাত্ররা জুনিয়র ও সিনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষা দিত। বঙ্কিম চন্দ্রের সাহিত্য প্রতিভার উন্মেষের পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন নৈহাটির নিকটবর্তী কাঁচড়াপাড়ার প্রসিদ্ধ স্বভাব কবি ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত। ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত সংবাদ প্রভাকর নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। এই পত্রিকার প্রধান লেখকও ছিলেন বঙ্কিম চন্দ্র।
তিনি ‘সংবাদ প্রভাকর’ কবিতা প্রতিযোগিতায় যোগদান করে কুড়ি টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার এই কবিতাটির নাম ‘কামিনীর প্রতি উক্তি তোমাতে লো ষড়ঋতু’ প্রকাশ কাল ১৮৫৩ খ্রি.। এই পুরস্কার প্রদান করেছিলেন আমাদের রংপুরের জমিদার রমনী মোহন চৌধুরী ও গোপালপুরের ‘রঙ্গপুর বার্তাবহ পত্রিকার' সম্পাদক কালী চন্দ্র রায় চৌধুরী।
১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিম চন্দ্র জুনিয়র স্কলারশিপ ও ১৮৫৬ খ্রি. সিনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ১৮৫৬ খ্রি. প্রেসিডেন্সি কলেজে আইন পড়ার জন্য প্রবেশ করেন।
১৮৫৭ খ্রি. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম এনট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রবর্তন হয়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে বঙ্কিম চন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজের আইন বিভাগ থেকে এনট্রান্স পরীক্ষা দেন। সর্বমোট ২৪৪ জন ছাত্র পরীক্ষা দিয়েছিল। তার ভেতর প্রথম বিভাগে ১১৫ জন ও দ্বিতীয় বিভাগে ৪৭ জন ছাত্র উত্তীর্ণ হন। বাকি ৮২ জন ছাত্র ফেল করে। কারণ তখন তৃতীয় বিভাগ বলে কিছু ছিল না। যারা শতকরা ৫০ বা তার বেশি নম্বর পেয়েছিলেন তারা প্রথম বিভাগে এবং যারা শতকরা ২৫ অথচ শতকরা ৫০-এর কম নম্বর পেয়েছিল, তারা দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। বঙ্কিম চন্দ্র প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। সে বছর উত্তরপাড়া স্কুল থেকে কবি হেম চন্দ্র বন্দোপাধ্যায় কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুল থেকে কৃষ্ণ কমল ভট্টাচার্য এবং হিন্দু স্কুল থেকে সতেন্দ্রনাথ ঠাকুর, গনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও যোগেন্দ্রনাথ ঘোষ প্রমুখও এনট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
পরের বছর অর্থাৎ ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম বিএ পরীক্ষার প্রবর্তন হলো। তখনও এফ,এ বর্তমান আইএ বা এইচএসসি পরীক্ষার প্রচলন হয়নি। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে এর প্রবর্তন হয়। সুতরাং সে সময় এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করেই বিএ পরীক্ষা দিতে হতো। কাজেই বঙ্কিম চন্দ্রকে আর আইএ বা এইচএসসি পরীক্ষা দিতে হয়নি। সে সময় সর্বমোট ১০ জন ছাত্র বি এ পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তার মধ্যে কেবল ২ জন বঙ্কিম চন্দ্র ও যদুনাথ বসু দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। বঙ্কিম চন্দ্র প্রথম ও যদুনাথ দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। দু’জনেই এরা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। বঙ্কিম চন্দ্র আইন বিভাগের ও যদুনাথ সাধারণ বিভাগের ছাত্র ছিলেন। বঙ্কিম চন্দ্র ও যদুনাথ ৬টি বিষয়ের মধ্যে ৫টিতে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু ষষ্ঠ বিষয়টি ছিল ‘মেন্টাল এন্ড মোরাল সায়েন্স’ কিন্তু এই ষষ্ঠ বিষয়টিতে তারা কিছু কম নম্বর পেয়ে ফেল করেন। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২৪ এপ্রিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় পরীক্ষকদের সুপারিশ অনুযায়ী ঐ দু’জনকে ৭ নম্বর গ্রেস দিয়ে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বলে বিবেচিত করবার প্রস্তাব নেয়া হয়। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসুর উপস্থিতিতে তাঁদের বিএ ডিগ্রী প্রদান করা হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেটি একটি বিশেষ মুহূর্ত। কারণ এরা দুজনেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্রাজুয়েট।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.