মধুসূদন নিয়ে দু চার কলম- ২
অবশেষে মধুসূদন ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরে এলেন। অর্থাভাবে পরিবার সাথে নিয়ে আসা সম্ভব নয়, তাই ফরাসী দেশে রেখে এলেন। বিদ্যাসাগর তাঁর জন্যে সুকিয়া স্ট্রীটে একটি বাড়ি ঠিক করে রাখলেন। কিন্তু বার এট ল-এর পক্ষে বাঙ্গালী পাড়ায় থাকা শোভন নয়। তাই তিনি সোজাসুজি সাহেবদের একটা হোটেলে গিয়ে উঠলেন এবং বড় বড় তিনটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে লাগলেন।
প্রথমে আইন ব্যবসায়ে তাঁর আয় ভালই হয়। কিন্তু তিনি আয়ের চাইতে প্রচুর ব্যয় করতে লাগলেন। এ সময় তাঁর চরিত্রগত অমিতব্যয়িতা ও অমিতচারিতা বিশেষভাবেই প্রশ্রয় পায়।
হেনরিয়েটা ছেলেমেয়েদর নিয়ে আরও প্রায় দু’ বছর ফরাসী দেশে থাকলেন। কিন্তু উড়চন্ডী মধুসূদনের পক্ষে তাঁদের নিয়মিতভাবে টাকা পাঠানো সম্ভবপর হয়ে উঠেনি। ফলে হেনরিয়েটা ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেশ অসুবিধায় পড়েন। তাই তিনি তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। এবং অর্থাভাবের দরুণ তাঁকে জাহাজের টিকেটের মূল্যহ্রাসের জন্যে আবেদন জানাতে হয়েছে।
হেনরিয়েটা ফিরে এলে তিনি লাউডট স্ট্রীটে মাসে চারশ’ টাকার একটি রাজপ্রাসাদতুল্য বাড়ি ভাড়া করলেন। আবাল্য তার স্বপ্ন মাত্র এই যে, জীবনটা ভোগ-বিলাস ও ঐশ্বর্য আড়ম্বরে অতিবাহিত এবং যতভাবে সম্ভব স্বার্থকায়িত করা। সাধারণ তুচ্ছ মানুষ প্রাত্যহিক জীবনে দিনের পর দিন যে দুঃসহ গ্লানি, অসম্মান, লাঞ্ছনা ও দৈন্যের মধ্যে কোনমতে টিকে থাকে, সে জীবন তার ঘৃণ্য। মানুষের এ জীবনটা কেঁচোর মত কাটিয়ে যাবার মধ্যে বিন্দুমাত্র বাহাদুরি নেই। তাই তো মধুসূদনের মধ্যে ক্ষণস্থায়ী নশ্বর জীবন উপভোগের দুর্বার স্পৃহা দেখা যায়।
জীবনটা ভোগ করতে হলে অর্থের প্রয়োজন। মধুসূদন যা আয় করেন, তাতে কুলায় না বলেই তাকে ধার-দেনা করতে হয়। ফলে তিনি ঋণভারে জর্জরিত হয়ে পড়লেন। তার অনবদ্য শরীর নানা কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হলো। তিনি মানসিক ধৈর্য হারালেন।
মধুসূদন স্বাধীন আইন ব্যবসা ছেড়ে চাকরি নিলেন।কিন্তু চাকরি করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই চাকরি ছেড়ে তিনি আবার আইন ব্যবসায় শুরু করলেন। কিন্তু পাওনাদারদের জ্বালায় অতিষ্ট হয়ে তিনি কলকাতা ছাড়লেন এবং পঞ্চকোট দেশীয় রাজার অধীনে আইন উপদেষ্টার কাজ নিলেন। কিন্তু স্বাধীনচেতা মধুসূদনের পক্ষে এ চাকরি করাও সম্ভব হয়নি। আবার তিনি কলকাতায় ফিরে এসে ব্যারিস্টারি শুরু করলেন।
এ সময় তিনি বেশ অসুস্থ। কণ্ঠনালীর প্রদাহ, হৃৎপি-ের দুর্বলতা, প্লীহা ও যকৃতের বৃদ্ধি, জ্বর ও রক্ত বমন প্রভৃতি নানা রোগে তিনি আক্রান্ত হয়ে পড়লেন। অসুস্থতার জন্যে শেষ পর্যন্ত তাকে ব্যারিস্টারি ব্যবসায় একেবারে বন্ধ করতে হলো। রোগ-শোক-অভাব-অনটন তার দেহ-মনকে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে দেয়। তিনি দুঃখ ভোলার জন্যে প্রচুর পরিমাণে মদ খেতে শুরু করলেন। অসুস্থ শরীরে মদ্যপান মৃত্যুর শামিল এবং জীবনের গ্লানি ও হতাশ থেকে তিনি মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করতে চেয়েছেন।
বেনিয়াপুকুর রোডের বাড়িতে মধুসূদন মৃত্যুশয্যায় শায়িত হয়ে মৃত্যুর ধীর অথচ নিশ্চিত পদধ্বনি শুনতে পেলেন। ভোর হতে রাত পর্যন্ত উত্তমার্ণদের জ্বালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। পাশের ঘরেই প্রাণপ্রিয়া হেনরিয়েটা শয্যাশায়িনী। অথচ তাকে ডাক্তার দেখাবার পর্যন্ত সামর্থ নেই। চরম লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও দারিদ্যের মধ্যে সহায়হীন ও বান্ধবহীন মধুসূদন মৃত্যুর সম্মুখীন হয়ে বিগত জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করতে লাগলেন। এই তো স্বাভাবিক। কেননা জীবনের কাছে তার আর প্রত্যাশা করার কিছুই নেই। সমগ্র জীবনভর তিনি মানুষের মত মানুষ হয়ে বাঁচার জন্যে কিনা প্রচেষ্টা করেছেন! কিন্তু এক দুর্জ্ঞেয় ভাগ্যের অঙ্গুলি হেলনে তাকে চূড়ান্ত পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে। তাই এ সময়ে তার মধ্যে আত্মঘাতী প্রচেষ্টা প্রবলভাবে দেখা দেয় এবং জীবনের অসারতা সম্পর্কে তিনি নিঃসহায় হন।
শেষ পর্যন্ত মধুসূদনকে দাতব্য চিকিৎসালায়ে স্থানান্তরিত করা হয়। আলীপুর জেনারেল হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় শায়িত মধুসূদন স্ত্রী হেনরিয়েটার মৃত্যুসংবাদ শুনতে পেলেন।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.