রোহিঙ্গা বাংলা সাহিত্য
মিয়ানমার মানেই মুসলমানদের মৃত্যুপুরী। দেশটির সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে এক সময়ের মুসলমানদের শান্তিময় আবাসভূমিকে গ্রাস করে নিচ্ছে সেখানকার হিংস্র রাখাইন নামে পরিচিত মগরা। তারা গ্রামের পর গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে রোহিঙ্গাদের বসতবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। নির্বিচারে হত্যা করছে নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ অসংখ্য রোহিঙ্গা মুসলমানকে। বাড়ি থেকে রোহিঙ্গা মহিলাদেরকে তুলে নিয়ে গিয়ে অমানবিকভাবে ইজ্জতহানী শেষে হত্যা করা হচ্ছে। পোড়া বসতবাড়ির ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে পোড়া লাশের উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকে জীবন বাঁচানোর জন্যে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের দেখামাত্রই গুলি করে হত্যা করছে দেশটির সেনাবাহিনী। কোন ধরনের মিডিয়াকর্মীকে সে সব এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। মানবিক বিপর্যয়ের এক জলন্ত জাহান্নামে পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গাদের বসতভিটা। অথচ তারাই আরাকানের প্রথম বসতি স্থাপনকারী মূল ধারার মূলজনগোষ্ঠী। জন্মগতভাবেই তারা আরাকানের নাগরিক, তাদের হাতেই পরিপুষ্টি অর্জন করেছে আরাকানের ইতিহাস ঐতিহ্য। এমনকি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য তাদের হাতেই সমৃদ্ধ হয়েছে। কবি দোলৎকাজী, মহাকবি আলাওল, কবি মরদনসহ বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগীয় শক্তিমান কবিরা তার উজ্জ্বল সাক্ষী।
দৌলত কাজী শুধু বাঙালী মুসলমান কবিদের মধ্যেই শ্রেষ্ঠ নন, প্রাচীন বাংলার শক্তিমান কবিদের মধ্যেও তিনি একজন শ্রেষ্ঠ কবি। বাস্তববাদী এ কবি মধ্যযুগকে পিছনে ফেলে সমকালীন আধুনিকতা বিনির্মাণের জন্য সাহিত্যের গতানুগতিক পথ মাড়িয়ে বাস্তবতার নিরিখে মানবীয় প্রেমকে উপজীব্য করে সাহিত্য রচনা করেন, ‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’ কাব্য যার জলন্ত উদাহরণ। চট্টগ্রামের রাউজান থানার সুলতানপুর গ্রামের কাজি বংশের সন্তান কবি দৌলত কাজী আরাকানে বাংলা সাহিত্য চর্চা করেন। এমনকি তিনি আরাকানে রাজসভার কাজীর পদে নিযুক্ত ছিলেন এবং এ কারণেই তিনি ‘দৌলত কাজী’ নামে পরিচিত হন। তিনি আরাকানের রাজা থিরি থু ধম্মার রাজত্বকালের (১৬২২-১৬৩৮ খ্রি.) মধ্যেই তার লস্কর উজির আশরাফ খানের আদেশ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’ কাব্য রচনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার কাব্য সমাপ্ত করার আগেই মারা যান, যেহেতু থিরি থু ধম্মার রাজত্বকালে তিনি এ কাব্য রচনা করেছিলেন সেহেতু ধারণা করা যায় যে তিনি ১৬২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই কাব্য রচনায় হাত দেন এবং মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। কাব্যে বন্দনা, মহাম্মদের সিফত এবং রোসাঙ্গের রাজার প্রশস্তি অংশে কবি মূলত তার বিশ্বাসের প্রতিধ্বনিই তুলেছেন।
দৌলত কাজী তার কাব্যের তৃতীয় পর্বে ‘রোসাঙ্গের রাজার প্রশস্তি’ শীর্ষক রাজার বন্দনা রচনা করেছেন। রাজার প্রশস্তির পাশাপাশি লস্কর উজীর আশরাফ খানের পরিচয়, চারিত্রিক বিশ্লেষণ, ইসলামের প্রতি তার আনুগত্য ও ভালবাসার চিত্র, রাজনৈতিক দক্ষতা, সততা, ইসলামের প্রসার ও প্রভাবে তার অবদানসহ বিভিন্ন বিষয়ের আলোকপাত করেছেন। মুসলিম অমাত্য আশরাফ খানের চরিত্র বিশ্লেষণ করে আরাকানে ইসলামের প্রসার ও প্রভাব বিশ্লেষণের পথ তৈরী করেছেন। সত্যিকার অর্থে মধ্যযুগে আরাকানের ইসলামের প্রভাব নির্ণয়ের উপাত্ত এবং প্রমাণপত্র হিসেবে কবি দৌলত কাজীর ‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’ কাব্যটি সহায়ক হিসেবে গ্রহণ করা যায়।
ভাগ্য বিড়ম্বিত মহাকবি আলাওল মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠকবি। তিনি আরাকানে অশ্বারোহী সৈন্য পদে চাকরি করলেও অচিরেই তিনি আরাকানের মুসলিম মন্ত্রীদের সুনজরে আসেন এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই তাঁর কাব্যসমূহ রচনা করেন। তাঁর রচিত পদ্মাবতী যা আরাকানরাজ থদো মিংদারের (১৬৪৫-১৬৫২ খ্রি.) শাসনামলে রাজসভার প্রভাবশালী অমাত্য ও কবি কোরেশী মাগন ঠাকুরের অনুরোধে ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন। কবি আলাওলের পদ্মাবতী কাব্যের সূচনাপর্বে যেমন তাঁর আল্লাহ্র একত্ববাদের ক্ষেত্রে অটুট বিশ্বাস এবং কুরআন-হাদিস সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের পরিচয় মেলে তেমনি আরাকানের প্রশাসন ও সমাজ জীবনেও ইসলামের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ‘সৎকীর্তি মাগনের প্রশংসা’ অংশে কবি আরাকানের অমাত্যসভা কর্তৃক মুসলমানদের জ্ঞান চর্চা ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে ইসলামের প্রভাব বিশ্লেষণের প্রয়াস পেয়েছেন।
খ. সতী ময়না-লোর চন্দ্রানী, যা মহাকবি আলাওল তাঁর অমর কাব্য ‘পদ্মাবতী’ রচনার পর আরাকানের রাজা সান্দা থু ধম্মার (১৬৫২-১৬৮৪ খ্রি.) শাসনামলে আরাকানের সৈন্যমন্ত্রী মুহাম্মদ সোলায়মানের পৃষ্ঠপোষকতায় দৌলত কাজী রচিত অসমাপ্ত কাব্যটি সমাপ্ত করেন। সেইসাথে সমকালীন আরাকানের প্রশাসনে মুসলিম প্রভাব ও উদার নৈতিক মূল্যবোধ এ কাব্যের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। মূলত এটি ছিল কবির মৌলিক রচনা।
গ. সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল, যা কবি আলাওল আরাকানের রাজা সান্দা থু ধম্মার শাসনামলে স্বীয় প্রধান অমাত্য মাগন ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতায় রচনা শুরু করেন। কবির রচিত হামদ-নাত অংশের চরণসমূহে কবির অন্তরাত্মার লালিত ইসলামের সুমহান আদর্শ, বিশ্বাস অনুভূতি, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও ভাবৈশ্বর্য ফুটে উঠেছে। কিন্তু এর শব্দ প্রয়োগে এবং ভাষায় ভঙ্গিতে আরবি-ফারসি প্রয়োগের পরিবর্তে দেশীয় উপকরণকে কাজে লাগিয়েছেন। এ ধরনের শব্দের ব্যবহার কবির উদার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীরই পরিচয় বহন করে এবং তিনি যে সত্যিকার অর্থেই ইসলামের উদারতাকে ধারণ করে প্রকৃত মুসলিম হিসেবে নিজকে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন তার একটি উজ্জ্বল প্রমাণ এ কাব্য।
ঘ. সপ্তপয়কর, যা তিনি ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের মুখ্য সেনাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ খানের আদেশ ও পৃষ্ঠপোষকতায় এ কাব্যটি রচনা করেন। কবি আলাওল একনিষ্ঠ মুসলমান হবার কারণে ইসলামী সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক যেমন অক্ষুণœ রয়েছে তেমনি আলাওলের অনুবাদে ইরানী ও ভারতীয় ঐতিহ্য যুক্ত হয়ে কাব্যের ভাষারস আরও নান্দনিক রূপ লাভ করেছে। সুতরাং কবি তাঁর কাব্যে এ ধরনের শব্দ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ইসলামের ঔদার্যকেই সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।
ঙ. ‘তোহফা’ মহাকবি আলাওলের একটি অন্যতম বিখ্যাত ও উপদেশমূলক কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থটি ১৬৬৩-৬৪ খ্রিস্টাব্দে কবি আলাওল আরাকানের মহামাত্য মুহম্মদ সোলায়মান এর আদেশে এর কাব্যানুবাদ ‘তোহফা’ নামে সম্পন্ন করেন। কাব্যটি আলাওলের ‘অনূদিত কাব্য’ হলেও অন্যান্য কাব্যের মত এখানেও তিনি অনুবাদের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা রক্ষা করেছেন।
চ. সিকান্দরনামা আলাওলের শেষ কাব্য গ্রন্থ। কবি আলাওল আরাকানের রাজা থিরি থু ধম্মার (১৬৫২-৮৪ খ্রি.) প্রধান অমাত্য নবরাজ মজলিশের আদেশ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ১৬৭১ থেকে ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এটি রচনা করেন। অনূদিত কাব্য হলেও এটি যেমন ছিল স্বাধীন ও ভাবানুবাদ তেমনি কাব্যের বিভিন্ন স্থানে নিজস্ব রচনাও বিদ্যমান।
মাগন ঠাকুর মধ্যযুগের একজন মৌলিক কবি। মৌলিক রচনার সংকটকালে কোরেশী মাগন ঠাকুরের ‘চন্দ্রাবতী’ কাব্য একটি বিরল উদাহরণ। বিশেষ করে আলাওল তাঁকে ভোজ্যবিদ্যায় পারদর্শী বলে উল্লেখ করেছেন এবং তার প্রমাণ স্বরূপ এ কাব্যে ভোজবিদ্যা বলে মানুষকে পাখি করে রাখা, চিত্রদর্শনে প্রেমে পড়া, ঝড়, সাপ, যক্ষ, রাক্ষস প্রভৃতির কবলে পড়া, বন থেকে অপহৃতা রাজকন্যাকে উদ্ধার করা প্রভৃতি উপস্থাপনের মাধ্যমে লোকজ ও দেশজ সংস্কৃতির উপস্থাপন করেছেন।
কবি দৌলত কাজীর সমসাময়িক কালের কবি ছিলেন মরদন। ঐতিহাসিক আবদুল করিম তাঁর নাম মরদন নুরুদ্দিন বলে উল্লেখ করেন। তিনি আরাকানের রাজা থিরি থু ধম্মা ওরফে সিকান্দার শাহ দ্বিতীয় এর শাসনামলে (১৬২২-১৬৩৮ খ্রি.) কাব্য চর্চা করেন। কবি মরদন রচিত কাব্যের নাম নসিবনামা। এ কাব্যের নামকরণ এবং ঘটনার বিররণীতে মৌলিক মিল লক্ষ্য করা যায়। সর্বোপরি এ কাব্য থেকে ওয়াদার প্রতি যত্নবান হওয়া, আল্লাহ্র প্রতি তাওয়াক্কুল করার শিক্ষা পাওয়া যায়।
উপরোদ্ধৃত ছাড়াও আরাকানে বিকশিত বাংলা সাহিত্যের আশু প্রভাবের ফলে চট্টগ্রামে বসবাসকারী অথচ ভাষা কিংবা পূর্বপুরুষ আরাকানী প্রশাসনের সাথে কোন না কোনভাবে জড়িত ছিলেন; এমন কবিদের সংখ্যাও কম নয়। আরাকান প্রশাসন প্রভাবিত কবিদের মধ্যে সপ্তদশ শতাব্দীর শক্তিশালী মুসলিম কবি নসরুল্লাহ খোন্দকার। তিনি চট্টগ্রামের অধিবাসী হলেও তার পূর্বপুরুষ বুরহান উদ্দীনসহ অনেকেই আরাকান অমাত্য সভায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। এ কবির তিনটি প্রধান কাব্যের সন্ধান পাওয়া যায় যথা জঙ্গনামা, মুসার সওয়াল ও শরীয়তনামা।
আরাকানের অমাত্য সভার পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত আর একজন কবির নাম আবদুল করিম খোন্দকার। তিনি আরাকানেই জন্ম গ্রহণ করেন। তার প্রপিতামহ রসুল মিয়া আরাকানের রাজার ‘বিষয় পদবী’ পেয়ে সমুদ্রপথে বাণিজ্য তরীর হাসিল উসুলকারী বা ট্যাক্স-কালেক্টররূপে কাজ করেন। পিতামহ মদন আলী আরাকানের রাজার দোভাষী বা ইন্টারপ্রেটর হিসেবে রাজা ও বিদেশী বণিকদের মধ্যে পারস্পরিক কথোপকথনের অনুবাদকের কাজ করতেন। তার পিতা আকবর আলী কোন বড় পদে ছিলেন কিনা তা কবি উল্লেখ করেননি। তবে কবি কমপক্ষে চারপুরুষ ধরে যে আরাকানে বসবাস করেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কবি আবদুল করিম খোন্দকার তিনটি কাব্য রচনা করেছেন যথা ‘দুল্লাহ মজলিশ’, হাজার মাসায়েল এবং তমিম আনসারী। কবি ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের রাজার রাজকোষাধ্যক্ষ আতিবর নামক জনৈক ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় কবি দুল্লা মজলিশ কাব্য রচনা করেন।
এ ছাড়াও শুজা কাজী নামে পরিচিত কবি আবদুল করিম অন্যতম কবি ছিলেন। তিনি আরাকানের সরদার পাড়ার অধিবাসী। এ কবি আঠাশ শতকের শুরুতে ইন্তেকাল করেন। তিনি কাব্যাকারে ‘রোসাঙ্গ পাঞ্চালা’ নামে আরাকানের ইতিহাস সম্বলিত একখানা কাব্য রচনা করেন। এ ছাড়াও ম্রোহংয়ের কবি আবুল ফজলের অংদমের লড়াই; আরাকানের কাইমের অধিবাসী কাজী আবদুল করিমের রাহাতুল কুলুব, আব্দুল্লাহর হাজার সওয়াল, নূরনামা, মধুমালতী, দরীগে মজলিশ; কাইমের অধিবাসী ইসমাইল সাকেব এর ‘বিলকিসনামা’; কাজী মোহাম্মদ হোসেন এর আমির হামজা, দেওলাল মতি ও হায়দরজঙ্গ; আরাকানের অন্যতম কবি ও কাব্যগ্রন্থ। আরাকানের ইতিহাস রচনা এবং ইসলামের প্রভাব বিশ্লেষণের জন্য কাব্যগুলি সহায়ক উৎস হিসেবে প্রয়োজনীয় হলেও এগুলোর প্রকাশনা ও সংরক্ষণের কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তবে এ সকল পুঁথির খন্ডিত ও বিচ্ছিন্ন কিছু কপি দেশের বিভিন্ন পাঠাগারে সংরক্ষিত আছে।
আরাকানের বাংলাসাহিত্য চর্চার ইতিহাস পর্যালোচনা করে বলা যায় যে, এ সব কবিদের ইতিহাস মধ্যযুগের। সে সময় আরাকানে ইসলামের যে সুমহান আদর্শ প্রচারিত হয়েছিল তা সাহিত্যের অঙ্গনকেও সফলভাবে প্রভাবিত করেছিল। সেখানকার সাহিত্যিকগণ যেমন ছিলেন খাঁটি মুসলমান এবং তাদের লেখনীতেও ঈমান ও ইসলাম চর্চার অনেক উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। যদি মুসলিম প্রশাসন উল্লেখযোগ্য হারে প্রভাবিত না থাকতো তাহলে সেখানে মুসলিম সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা সম্ভব ছিল না। অথচ বর্তমানে সেখানকার মুসলমানদের ভীণদেশী বলে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এটা শুধু অমানবিকই নয়, বরং জবরদখলের চরম মাত্রা। মগের মুলুকের সেই প্রবাদ যেন আজো সেখানে বাস্তাবায়ন করা হচ্ছে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
দৌলত কাজী শুধু বাঙালী মুসলমান কবিদের মধ্যেই শ্রেষ্ঠ নন, প্রাচীন বাংলার শক্তিমান কবিদের মধ্যেও তিনি একজন শ্রেষ্ঠ কবি। বাস্তববাদী এ কবি মধ্যযুগকে পিছনে ফেলে সমকালীন আধুনিকতা বিনির্মাণের জন্য সাহিত্যের গতানুগতিক পথ মাড়িয়ে বাস্তবতার নিরিখে মানবীয় প্রেমকে উপজীব্য করে সাহিত্য রচনা করেন, ‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’ কাব্য যার জলন্ত উদাহরণ। চট্টগ্রামের রাউজান থানার সুলতানপুর গ্রামের কাজি বংশের সন্তান কবি দৌলত কাজী আরাকানে বাংলা সাহিত্য চর্চা করেন। এমনকি তিনি আরাকানে রাজসভার কাজীর পদে নিযুক্ত ছিলেন এবং এ কারণেই তিনি ‘দৌলত কাজী’ নামে পরিচিত হন। তিনি আরাকানের রাজা থিরি থু ধম্মার রাজত্বকালের (১৬২২-১৬৩৮ খ্রি.) মধ্যেই তার লস্কর উজির আশরাফ খানের আদেশ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’ কাব্য রচনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার কাব্য সমাপ্ত করার আগেই মারা যান, যেহেতু থিরি থু ধম্মার রাজত্বকালে তিনি এ কাব্য রচনা করেছিলেন সেহেতু ধারণা করা যায় যে তিনি ১৬২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই কাব্য রচনায় হাত দেন এবং মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। কাব্যে বন্দনা, মহাম্মদের সিফত এবং রোসাঙ্গের রাজার প্রশস্তি অংশে কবি মূলত তার বিশ্বাসের প্রতিধ্বনিই তুলেছেন।
দৌলত কাজী তার কাব্যের তৃতীয় পর্বে ‘রোসাঙ্গের রাজার প্রশস্তি’ শীর্ষক রাজার বন্দনা রচনা করেছেন। রাজার প্রশস্তির পাশাপাশি লস্কর উজীর আশরাফ খানের পরিচয়, চারিত্রিক বিশ্লেষণ, ইসলামের প্রতি তার আনুগত্য ও ভালবাসার চিত্র, রাজনৈতিক দক্ষতা, সততা, ইসলামের প্রসার ও প্রভাবে তার অবদানসহ বিভিন্ন বিষয়ের আলোকপাত করেছেন। মুসলিম অমাত্য আশরাফ খানের চরিত্র বিশ্লেষণ করে আরাকানে ইসলামের প্রসার ও প্রভাব বিশ্লেষণের পথ তৈরী করেছেন। সত্যিকার অর্থে মধ্যযুগে আরাকানের ইসলামের প্রভাব নির্ণয়ের উপাত্ত এবং প্রমাণপত্র হিসেবে কবি দৌলত কাজীর ‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’ কাব্যটি সহায়ক হিসেবে গ্রহণ করা যায়।
ভাগ্য বিড়ম্বিত মহাকবি আলাওল মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠকবি। তিনি আরাকানে অশ্বারোহী সৈন্য পদে চাকরি করলেও অচিরেই তিনি আরাকানের মুসলিম মন্ত্রীদের সুনজরে আসেন এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই তাঁর কাব্যসমূহ রচনা করেন। তাঁর রচিত পদ্মাবতী যা আরাকানরাজ থদো মিংদারের (১৬৪৫-১৬৫২ খ্রি.) শাসনামলে রাজসভার প্রভাবশালী অমাত্য ও কবি কোরেশী মাগন ঠাকুরের অনুরোধে ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন। কবি আলাওলের পদ্মাবতী কাব্যের সূচনাপর্বে যেমন তাঁর আল্লাহ্র একত্ববাদের ক্ষেত্রে অটুট বিশ্বাস এবং কুরআন-হাদিস সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের পরিচয় মেলে তেমনি আরাকানের প্রশাসন ও সমাজ জীবনেও ইসলামের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ‘সৎকীর্তি মাগনের প্রশংসা’ অংশে কবি আরাকানের অমাত্যসভা কর্তৃক মুসলমানদের জ্ঞান চর্চা ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে ইসলামের প্রভাব বিশ্লেষণের প্রয়াস পেয়েছেন।
খ. সতী ময়না-লোর চন্দ্রানী, যা মহাকবি আলাওল তাঁর অমর কাব্য ‘পদ্মাবতী’ রচনার পর আরাকানের রাজা সান্দা থু ধম্মার (১৬৫২-১৬৮৪ খ্রি.) শাসনামলে আরাকানের সৈন্যমন্ত্রী মুহাম্মদ সোলায়মানের পৃষ্ঠপোষকতায় দৌলত কাজী রচিত অসমাপ্ত কাব্যটি সমাপ্ত করেন। সেইসাথে সমকালীন আরাকানের প্রশাসনে মুসলিম প্রভাব ও উদার নৈতিক মূল্যবোধ এ কাব্যের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। মূলত এটি ছিল কবির মৌলিক রচনা।
গ. সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল, যা কবি আলাওল আরাকানের রাজা সান্দা থু ধম্মার শাসনামলে স্বীয় প্রধান অমাত্য মাগন ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতায় রচনা শুরু করেন। কবির রচিত হামদ-নাত অংশের চরণসমূহে কবির অন্তরাত্মার লালিত ইসলামের সুমহান আদর্শ, বিশ্বাস অনুভূতি, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও ভাবৈশ্বর্য ফুটে উঠেছে। কিন্তু এর শব্দ প্রয়োগে এবং ভাষায় ভঙ্গিতে আরবি-ফারসি প্রয়োগের পরিবর্তে দেশীয় উপকরণকে কাজে লাগিয়েছেন। এ ধরনের শব্দের ব্যবহার কবির উদার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীরই পরিচয় বহন করে এবং তিনি যে সত্যিকার অর্থেই ইসলামের উদারতাকে ধারণ করে প্রকৃত মুসলিম হিসেবে নিজকে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন তার একটি উজ্জ্বল প্রমাণ এ কাব্য।
ঘ. সপ্তপয়কর, যা তিনি ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের মুখ্য সেনাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ খানের আদেশ ও পৃষ্ঠপোষকতায় এ কাব্যটি রচনা করেন। কবি আলাওল একনিষ্ঠ মুসলমান হবার কারণে ইসলামী সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক যেমন অক্ষুণœ রয়েছে তেমনি আলাওলের অনুবাদে ইরানী ও ভারতীয় ঐতিহ্য যুক্ত হয়ে কাব্যের ভাষারস আরও নান্দনিক রূপ লাভ করেছে। সুতরাং কবি তাঁর কাব্যে এ ধরনের শব্দ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ইসলামের ঔদার্যকেই সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।
ঙ. ‘তোহফা’ মহাকবি আলাওলের একটি অন্যতম বিখ্যাত ও উপদেশমূলক কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থটি ১৬৬৩-৬৪ খ্রিস্টাব্দে কবি আলাওল আরাকানের মহামাত্য মুহম্মদ সোলায়মান এর আদেশে এর কাব্যানুবাদ ‘তোহফা’ নামে সম্পন্ন করেন। কাব্যটি আলাওলের ‘অনূদিত কাব্য’ হলেও অন্যান্য কাব্যের মত এখানেও তিনি অনুবাদের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা রক্ষা করেছেন।
চ. সিকান্দরনামা আলাওলের শেষ কাব্য গ্রন্থ। কবি আলাওল আরাকানের রাজা থিরি থু ধম্মার (১৬৫২-৮৪ খ্রি.) প্রধান অমাত্য নবরাজ মজলিশের আদেশ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ১৬৭১ থেকে ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এটি রচনা করেন। অনূদিত কাব্য হলেও এটি যেমন ছিল স্বাধীন ও ভাবানুবাদ তেমনি কাব্যের বিভিন্ন স্থানে নিজস্ব রচনাও বিদ্যমান।
মাগন ঠাকুর মধ্যযুগের একজন মৌলিক কবি। মৌলিক রচনার সংকটকালে কোরেশী মাগন ঠাকুরের ‘চন্দ্রাবতী’ কাব্য একটি বিরল উদাহরণ। বিশেষ করে আলাওল তাঁকে ভোজ্যবিদ্যায় পারদর্শী বলে উল্লেখ করেছেন এবং তার প্রমাণ স্বরূপ এ কাব্যে ভোজবিদ্যা বলে মানুষকে পাখি করে রাখা, চিত্রদর্শনে প্রেমে পড়া, ঝড়, সাপ, যক্ষ, রাক্ষস প্রভৃতির কবলে পড়া, বন থেকে অপহৃতা রাজকন্যাকে উদ্ধার করা প্রভৃতি উপস্থাপনের মাধ্যমে লোকজ ও দেশজ সংস্কৃতির উপস্থাপন করেছেন।
কবি দৌলত কাজীর সমসাময়িক কালের কবি ছিলেন মরদন। ঐতিহাসিক আবদুল করিম তাঁর নাম মরদন নুরুদ্দিন বলে উল্লেখ করেন। তিনি আরাকানের রাজা থিরি থু ধম্মা ওরফে সিকান্দার শাহ দ্বিতীয় এর শাসনামলে (১৬২২-১৬৩৮ খ্রি.) কাব্য চর্চা করেন। কবি মরদন রচিত কাব্যের নাম নসিবনামা। এ কাব্যের নামকরণ এবং ঘটনার বিররণীতে মৌলিক মিল লক্ষ্য করা যায়। সর্বোপরি এ কাব্য থেকে ওয়াদার প্রতি যত্নবান হওয়া, আল্লাহ্র প্রতি তাওয়াক্কুল করার শিক্ষা পাওয়া যায়।
উপরোদ্ধৃত ছাড়াও আরাকানে বিকশিত বাংলা সাহিত্যের আশু প্রভাবের ফলে চট্টগ্রামে বসবাসকারী অথচ ভাষা কিংবা পূর্বপুরুষ আরাকানী প্রশাসনের সাথে কোন না কোনভাবে জড়িত ছিলেন; এমন কবিদের সংখ্যাও কম নয়। আরাকান প্রশাসন প্রভাবিত কবিদের মধ্যে সপ্তদশ শতাব্দীর শক্তিশালী মুসলিম কবি নসরুল্লাহ খোন্দকার। তিনি চট্টগ্রামের অধিবাসী হলেও তার পূর্বপুরুষ বুরহান উদ্দীনসহ অনেকেই আরাকান অমাত্য সভায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। এ কবির তিনটি প্রধান কাব্যের সন্ধান পাওয়া যায় যথা জঙ্গনামা, মুসার সওয়াল ও শরীয়তনামা।
আরাকানের অমাত্য সভার পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত আর একজন কবির নাম আবদুল করিম খোন্দকার। তিনি আরাকানেই জন্ম গ্রহণ করেন। তার প্রপিতামহ রসুল মিয়া আরাকানের রাজার ‘বিষয় পদবী’ পেয়ে সমুদ্রপথে বাণিজ্য তরীর হাসিল উসুলকারী বা ট্যাক্স-কালেক্টররূপে কাজ করেন। পিতামহ মদন আলী আরাকানের রাজার দোভাষী বা ইন্টারপ্রেটর হিসেবে রাজা ও বিদেশী বণিকদের মধ্যে পারস্পরিক কথোপকথনের অনুবাদকের কাজ করতেন। তার পিতা আকবর আলী কোন বড় পদে ছিলেন কিনা তা কবি উল্লেখ করেননি। তবে কবি কমপক্ষে চারপুরুষ ধরে যে আরাকানে বসবাস করেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কবি আবদুল করিম খোন্দকার তিনটি কাব্য রচনা করেছেন যথা ‘দুল্লাহ মজলিশ’, হাজার মাসায়েল এবং তমিম আনসারী। কবি ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের রাজার রাজকোষাধ্যক্ষ আতিবর নামক জনৈক ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় কবি দুল্লা মজলিশ কাব্য রচনা করেন।
এ ছাড়াও শুজা কাজী নামে পরিচিত কবি আবদুল করিম অন্যতম কবি ছিলেন। তিনি আরাকানের সরদার পাড়ার অধিবাসী। এ কবি আঠাশ শতকের শুরুতে ইন্তেকাল করেন। তিনি কাব্যাকারে ‘রোসাঙ্গ পাঞ্চালা’ নামে আরাকানের ইতিহাস সম্বলিত একখানা কাব্য রচনা করেন। এ ছাড়াও ম্রোহংয়ের কবি আবুল ফজলের অংদমের লড়াই; আরাকানের কাইমের অধিবাসী কাজী আবদুল করিমের রাহাতুল কুলুব, আব্দুল্লাহর হাজার সওয়াল, নূরনামা, মধুমালতী, দরীগে মজলিশ; কাইমের অধিবাসী ইসমাইল সাকেব এর ‘বিলকিসনামা’; কাজী মোহাম্মদ হোসেন এর আমির হামজা, দেওলাল মতি ও হায়দরজঙ্গ; আরাকানের অন্যতম কবি ও কাব্যগ্রন্থ। আরাকানের ইতিহাস রচনা এবং ইসলামের প্রভাব বিশ্লেষণের জন্য কাব্যগুলি সহায়ক উৎস হিসেবে প্রয়োজনীয় হলেও এগুলোর প্রকাশনা ও সংরক্ষণের কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তবে এ সকল পুঁথির খন্ডিত ও বিচ্ছিন্ন কিছু কপি দেশের বিভিন্ন পাঠাগারে সংরক্ষিত আছে।
আরাকানের বাংলাসাহিত্য চর্চার ইতিহাস পর্যালোচনা করে বলা যায় যে, এ সব কবিদের ইতিহাস মধ্যযুগের। সে সময় আরাকানে ইসলামের যে সুমহান আদর্শ প্রচারিত হয়েছিল তা সাহিত্যের অঙ্গনকেও সফলভাবে প্রভাবিত করেছিল। সেখানকার সাহিত্যিকগণ যেমন ছিলেন খাঁটি মুসলমান এবং তাদের লেখনীতেও ঈমান ও ইসলাম চর্চার অনেক উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। যদি মুসলিম প্রশাসন উল্লেখযোগ্য হারে প্রভাবিত না থাকতো তাহলে সেখানে মুসলিম সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা সম্ভব ছিল না। অথচ বর্তমানে সেখানকার মুসলমানদের ভীণদেশী বলে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এটা শুধু অমানবিকই নয়, বরং জবরদখলের চরম মাত্রা। মগের মুলুকের সেই প্রবাদ যেন আজো সেখানে বাস্তাবায়ন করা হচ্ছে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.