স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ দের কথা- ৭ (বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মাদ)
থরে থরে সাজানো মনকাড়া গন্ধে মৌ মৌ হয়ে থাকে স্বপ্নের জন্মভূমি। আজনম স্বপ্নের চাদরে মোড়ানো এমন মাটিতেই সঠিক সময়ে আসেন নূর মোহাম্মাওরা। ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ছিলো এমন একটি দিন। বাংলার সবুজ প্রান্তরে এসেছিলেন নূর মোহাম্মাদ শেখ নামক এক শ্রেষ্ঠ বীর! মা-বাবার একমাত্র সন্তান নূরের আগমনে গোটা পরিবারে খুশির বন্যা! আমোদে আহ্লাদে সীমাহীন আদরে বড় হতে লাগলেন এই বীর সন্তান। একমাত্র সন্তান হওয়ায় যা আশা করতেন তাই তার হাতে আসতো।
সমাজ, মানুষ, প্রকৃতির জন্য যিনি জীবন দিবেন তিনি কি এসবের মায়া থেকে দূরে থাকতে পারেন? তাই তো সব কিছুর মায়ায় সবার সাথেই ভাব তার। সে কারনেই একজন স্বপ্নবাজ নাট্যকর্মী ও সংস্কৃতি রক্ষক হয়ে উঠলেন। যারা সবার ভাষা বুঝে, সবার সাথে মিতালি গড়তে জানে তারাই সংস্কৃতি কর্মী। সে সময় গ্রামের যাত্রা পালা, থিয়েটার, মঞ্চে নূরের ছিলো স্বরব উপস্থিতি। মানুষ খুব সহজেই নূর মোহাম্মাদকে পছন্দ করে নিলো। এরই মাঝে একদিন কলের গান কিনে রীতিমত গ্রাম উজাড় করে ফেললেন। কয়েক গ্রাম উজাড় হয়ে ভেঙ্গে পড়লো নূর মোহাম্মাদের বাড়িতে।
কলের গান বলে কথা! তৎকালীন সময়ে খুব অর্থ সম্পন্ন মানুষও কদাচিৎ কলের গান কেনার দৃষ্টান্ত দেখাতেন। এমন একটি যন্ত্রের কল্যাণে নূরের উঠানে রাত-দিন চলতে থাকলো গানের আসর। যেন ঘোরে আবদ্ধ গ্রাম নাওয়া খাওয়া কাজ ফেলে নূর মোহাম্মাদের বাড়িতে আবদ্ধ হয়ে পড়লেন। খুশির জোয়ার সবখানে। যেন ক্লান্তিরা বিদায় নিয়েছিলো! এমনই প্রাণ খোলা ব্যাক্তি আমাদের গর্বের ধন নূর মোহাম্মাদ শেখ! একদিন বেরিয়ে পড়লেন বাড়ি থেকে। উদ্দেধ্য সংস্কৃতির জগতে পাকাপাকি ভাবেই পদার্পন করা। কিন্তু ঐ সময় সংস্কৃতিতে জড়িত হওয়া কিংবা সঠিক নিশানা বের করা খুবই কঠিন কাজ ছিলো। ঘুরে ঘুরে দলের সন্ধান না পেয়ে নূর মোহাম্মাদ যুক্ত হয়ে পড়েন আনসার বাহিনীতে।
এই বাহিনীর জীবনই নূর মোহাম্মাদের ডানপিটে সভাবকে করে দিলো সুশৃংখল! ফলে একটি অপ্রতিরোধ্য স্বভাব শৃংখলাবোধে আরো কার্যকর রুপ পরিগ্রহ করলো। বুক ভরা স্বপ্ন আর সুশৃংখল সেই জীবন। এরপর আনসার বাহিনীর শারিরিক চর্চা আর শৃংখলা জ্ঞানই তাকে ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্টে ভর্তি হতে সাহায্য করলো। এর মাঝে গ্রামে ফিরে এসে অবস্থা সম্পন্ন কৃষক পরিবারে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ১৯৫৯ সালের ১৪ মার্চ যুক্ত হন ইপিআর এ। এভাবে সময় গড়াতে থাকে আমুদে নূর মোহাম্মাদও ধীরে ধীরে আরো পরিপক্ক হয়ে বেড়ে ওঠেন।
১৯৭০ এর নির্বাচনের দেশের শুরু হল রাজনৈতিক অস্থিরতা। ক্যাম্পে বসে সংবাদ নিয়ে নূর মোহাম্মাদ তার সংস্কৃতি কর্মীর চোখে দিব্য সব উপলব্ধি করে ফেললেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন আজন্ম ডানপিটে স্বভাবকে কাজে লাগানোর দিন খুব বেশি দূরে নয়। তাক পালাতে হবে। দেশের ক্রান্ত লগ্ন খুবই কাছে। ফলে যে ক্যাম্পে তিনি প্রশিক্ষিত হয়েছেন সেই হানাদার ক্যাম্পের দিকেই তাকে ফিরে আসতে হবে মুক্তিযোদ্ধার বেশে! দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ, সংগ্রামের অর্থ একজন সংস্কৃতি কর্মীর চেয়ে আর কে বেশি ভালো জানতে পারে? বঙ্গবন্ধুর প্রত্যেকটা বাক্য ও ত্যার ভেতর শব্দের যে শক্তিমত্তা সেগুলোর প্রতিটা তার মনের ভেতর বিপুল ঢেউ তৈরি করতো।
অক্ষরে অক্ষরে শিহরিত হতেন নূর মোহাম্মাদ। ের মাঝেই টালমাটাল উত্তেজনা শুরু হল বাহিনীর অভ্যন্তরে! পাঞ্জাবী সদস্যদের চোখে মুখে স্পষ্ট বাঙ্গালী বিদ্বেষ।এর মাঝেই প্রতি রাতে বিমান ভর্তি করে আনা হচ্ছে পাঞ্জাবি জাওয়ান ও রসদ। নূর মোহাম্মাদ তার চাতুর্য ও জ্ঞাণ ব্যবহার করে ঠিকই প্রচন্ড পাহারা ভেঙ্গে এক রাতে পালিয়ে এলেন ইপিআর ক্যাম্প থেকে। পালিয়ে ঐ রাতেই বিভিন্ন বাহিনী থেকে পলায়নকারী সদস্যদের স্থে মিলিত হন। সময় নেই একদম। প্রাণের স্বাধীনতা ক্যাম্প থেকেই তাকে অধিনায়ক করে পাঠানো হয় যশোরের গোয়ালহাটি গ্রামে। সে স্খানে তার নেতৃত্বে বসলো স্থায়ী টহল। পার্শ্ববর্তী সুতিরপূরস্থ মুক্তিযোদ্ধা ঘাঁটির নিরাপত্তা দিতে এই টহল ছিলো আবশ্যক।নূর মোহাম্মাদের সাথে ছিলেন আরো ৪ জন সহযোদ্ধা। ৫ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে নয়টার দিকে হঠাৎ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পেট্রোলটি তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। পেছনে মুক্তিযোদ্ধাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা থেকে পাল্টা গুলিবর্ষণ করা হয়। তবু পেট্রোলটি উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। এক সময়ে সিপাহী নান্নু মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে নূর মোহাম্মদ নান্নু মিয়াকে কাঁধে তুলে নেন এবং হাতের এল.এম.জি দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করলে শত্রুপক্ষ পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। হঠাৎ করেই শত্রুর মর্টারের একটি গোলা এসে লাগে তাঁর ডান কাঁধে। ধরাশয়ী হওয়া মাত্র আহত নান্নু মিয়াকে বাঁচানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন।
হাতের এল.এম.জি সিপাহী মোস্তফাকে দিয়ে নান্নু মিয়াকে নিয়ে যেতে বললেন এবং মোস্তফার রাইফেল চেয়ে নিলেন যতক্ষণ না তাঁরা নিরাপদ দূরুত্বে সরে যেতে সক্ষম হন ততক্ষণে ঐ রাইফেল দিয়ে শত্রুসৈন্য ঠেকিয়ে রাখবেন এবং শত্রুর মনোযোগ তাঁর দিকেই কেন্দ্রীভুত করে রাখবেন। অন্য সঙ্গীরা তাদের সাথে অনুরোধ করলেন যাওয়ার জন্যে। কিন্তু নূর মোহাম্মাদ কি প্ন্য আর সবার মত? তিনি যে বীর শ্রেষ্ঠ! তিনি যে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা! শ্রেষ্ঠ আত্মত্যাগী বীর!! তাঁকে বহন করে নিয়ে যেতে গেলে সবাই মারা পড়বে এই আশঙ্কায় তিনি রণক্ষেত্র ত্যাগ করতে রাজি হলেন না। বাকিদের অধিনায়োকোচিত আদেশ দিলেন তাঁকে রেখে চলে যেতে। তাঁকে রেখে সন্তর্পণে সরে যেতে পারলেন বাকিরা। এদিকে সমানে গুলি ছুড়তে লাগলেন রক্তাক্ত নূর মোহাম্মদ। একদিকে পাকিস্তানী সশস্ত্রবাহিনী, সঙ্গে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র, অন্যদিকে মাত্র অর্ধমৃত সৈনিক! সম্বল একটি রাইফেল ও সীমিত গুলি।
এই অসম অবিশ্বাস্য যুদ্ধে একাই তিনি পাকিস্তানি হানাদারদের এমন ক্ষতিসাধন করেন যে তারা এই মৃত্যুপথযাত্রী যোদ্ধাকে বেয়নেট দিয়ে বিকৃত করে চোখ দুটো উপড়ে ফেলে। পরে প্রতিরক্ষার সৈনিকরা এসে হানাদারদের হটিয়ে পাশের একটি ঝাড় থেকে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে। নূর মোহাম্মদ শেখ মরতে ভয় পাননি। দেশামাতৃকার কাছে নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে হয়েছে তাঁর। এ জন্যই তিনি বীরশ্রেষ্ঠ, উন্নত শক্তির ধারক। সহযোদ্ধারা তাঁকে যশোরের কাশিপুরে সমাহিত করেন। পরে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী সাড়াতল বাজারে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কলেজ। স্বাধীনতার ৩৭ বছর পর এ বীরশ্রেষ্ঠর জন্মগ্রাম মহেষখোলার নাম হয়েছে নূর মোহাম্মদনগর।
নূর মোহাম্মদনগরের পার্শ্ববর্তী ফেদি গ্রামে জেলা পরিষদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ মহাবিদ্যালয়ের ১২ শতাংশ জমির ওপর ৬২ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ লাইব্রেরি ও জাদুঘর। আর এভাবেই একজন সংস্কৃতি কর্মী নূর মোহাম্মাদ বীর শ্রেষ্ঠ হয়ে দেশমাতৃকার তরে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর! আমরা কতটুকু স্বরন করছি তাদের? কখনো দোয়ার হাতটি নূর মোহাম্মাদদের জন্য কি কেঁপে ওঠে?- এ প্রশ্ন করে পাঠকদের আর কষ্ট দিতে চাইনা।
সূত্রঃ স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা,
বীরশ্রেষ্ঠ,
স্বাধীনতা যুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা,
মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধূরী গবেষনা।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.