স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ দের কথা- ৬ (বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রব)
হাজী শরিয়তুল্লাহর চারন ভূমি ফরিদপুরে ১৯৪৩ সালের মে মাসে ঘর আলো করে জন্ম গ্রহন করেন বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ। বাবা-মার একমাত্র সন্তান আব্দুর রউফকে পড়া শুনা করিয়ে বড় মানুষ করার নেশায় দিন কাটলে লাগলো বাবা মুন্সি মেহেদী হোসেন এবং মা মকিদুন্নেসার। শরিয়তুল্লার এলাকা বলেই স্বাধীনচেতা ফরিদপুর নিবাসী মুন্সি আব্দুর রউফ শিশুকাল থেকেই ছিলেন স্বাধীনতা সচেতন। সে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এত তীব্র ছিলো যে তার পছন্দের বাইরে যেতে পারতেন না কোন ক্রমেই। বাবা মুন্সি মেহেদী হোসেন ছিলেন এলাকার ইমাম সাহেব। প্রতিদিন শিশু আব্দুর রউফকে অক্ষরজ্ঞাণ প্রদান ছিলো তার মিশনের অংশ। বাবার আগ্রহে শিশুকালে অক্ষরজ্ঞাণ লাভ করেন আব্দুর রউফ। বাবা তাকে রব বলে ডাকতেন। মা মকিদুন্নেসা ছিলেন অক্ষরজ্ঞান সম্পন্না গৃহিনী। তিনিও ছেলের লেখাপড়া নিয়ে ছিলেন পেরেশান। অথচ এমন একটি পরিবারে বেড়ে ওঠা রউফের মনোযোগ নেই পড়াশুনায়। সারা দিন মাঠে, ঘাটে, নদীতে ঘুরে বেড়াতে আর পশু পাখির সাথে বন্ধুত্ব করতেই দিন যেত তার। মায়ের আদেশ উপেক্ষা করে ভালো লাগার এই কাজ তার নেশা। একদিন মা রউফকে বকা দিলেন। রউফও বাড়ি থেকে দৌড়ে পালাতে লাগলো। নদীর পাড়ে গিয়ে মাকে ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললো তাড়া করলে সে পানিতে ঝাপ দেবে। দরদী মা একমাত্র ছেলের মুখে এমন কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলেন। এরপর থেকে আর কখনো তিনি রউফের মতের ওপর কথা বলেননি। দিন যেতে লাগলো রউফের। রউফের ছোট চাচা ছিলেন ইপিআর এর সদস্য। যখন ছুটিতে তিনি বাড়ি আসতেন তখনই রউফের ভালো লাগার দিন গুলো আরো রঙ্গীন হয়ে উঠতো। চাচ্চুর মুখে সৈনিকদের দুর্ধর্ষ জীবন শুনতে খুবই ভালো লাগতো রউফের। চাচ্চুর সাথে ভাব জমিয়ে সোইনিক জীবনের গল্পে হারিয়ে যেতেন কল্পনার রাজ্যে। নিজেকে আবিস্কার করতেন সৈনিকের সংগ্রামী ক্যাম্পে। ততদিনে পড়াশুনা গোল্লায় গেছে। অসম্ভব মেধাবী রউফ পড়াশুনায় মনোযোগ দিতেন না। একদিন সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে বাবা মারা গেলে রউফের জীবন পরিবর্তন হয়ে যায়। মা বাড়ি বাড়ি কাজ জোরাড় করে সন্তানদের মুখে ভাত তুলে দেয়ার সংগ্রামে যুক্ত হলে রউফ ভাবনায় পড়ে গেলেন। ছোট্ট শিশু বয়সে কী করতে পারেন তিনি? এর মাঝেই চাচ্চুর কাছে শোনা গল্পই তাকে দৃঢ় সংকল্প এনে দিলো পড়াশোনায়। তিনি শপথ করলেন যে করেই হোক পড়াশুনা করে অন্তত ৭ম শ্রেণী পাশ করতে হবে তাকে। কারন ইপিআরে যুক্ত হতে ৭ম শ্রণী পাশ করতে হত সে সময়। প্রচন্ড মেধাবী রউফের পরিচয় পাওয়া গেলো সে সময় একে একে চমৎকার রেজাল্ট করে অষ্টম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলেন রউফ। গ্রামে ততদিনে মেধাবী শিক্ষার্থীর পরিচয় তার। সপ্তম শ্রেণী পাশ করেই যুক্ত হলেন ইপিআরে। কাংখিত যোদ্ধার পরিবেশে রউফ সারাক্ষন ভাবতেন মায়ের কথা, ছোট বোনের কথা, গ্রামের কথা। সবসময় মায়ের খোজ রাখতেন, টাকা পাঠিয়ে সান্তনা দিতেন মাকে। তিনি থাকতে কোন চিন্তা নেই মায়ের। এর মাঝেই চারিদিকে যুদ্ধের দামামা শুরু হল। পাকিস্তানিদের অত্যাচারে বাঙ্গালী অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। যে কোন সময় যুদ্ধ অনিবার্য! ১৯৭১ সালে রউফ এক চিঠিতে মাকে জানিয়েছিলেন, ‘এখনকাজের চাপ বেড়ে গেছে। তাই আগের মতো ঘন ঘন ছুটি পাই না৷ তুমি চিন্তা করো না মা! ছুটি পেলেই বাড়ী এসে ছোট বোনের বিয়ে দিবো ৷’ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে মুন্সি আব্দুর রউফ চট্টগ্রামে ১১ উইং-এ চাকরিরত ছিলেন৷ তিনি ছিলেন মাঝারি মেশিনগান ডিপার্টমেন্টের ১ নং মেশিনগান চালক৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হন৷ চারিদিকে যুদ্ধের সংবাদ। মাঝে মাঝেই ছোট খাট অপারেশন চলছে এখানে সেখানে। এর মাঝেই একদিন রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি জলপথ দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৭ টি স্পীড বোট তীব্র গতিতে ছুটে আসতে লাগলো। পেছনে দুটি লঞ্চে ভারি অস্ত্র ও পাকসদস্য বোঝাই। এই জলপথ পাহারা দ্বায়িত্বে রউফের টিম। সেদিন, ৮ এপ্রিল তারিখ৷ শুরু হল তীব্র গোলাগুলি। পাক বাহিনীর অস্ত্র শস্ত্রের বিপরীতে মনোবল ও অসীম দেশপ্রেমই মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্বল। অচিরেই অস্ত্রের ব্যাপক আঘাতে মুক্তি বাহিনী পেছনে হটা ছাড়া আর কোন পথ দেখলো না। আত্মরক্ষার্থে তাই পিছু হটার স্বীদ্ধান্ত হল। কমান্ডার রউফ তাই সকলকে পিছু হটার স্বীদ্ধনাত জানিয়ে দিলে যে যার মত দ্রুত সরে পড়তে লাগলো। ওদিকে তড়িৎ গতিতে এগিয়ে আসছে পাক বাহিনী। একজন কাভার দিয়ে পেছনে না থাকলে সহজেই পাক বাহিনী পুরো টিমকে কব্জা করে ফেলবে। সব পরিস্থিতি বুঝে মুন্সি রউফ স্বীদ্ধনাত নিলেন পেছনে কাভার দেয়ার। সকল সঙ্গী চলে গেলেও রউফ তাই থেকে গেলেন পেহনে। নিজের বাংকার থেকে অনবরত মেশিনগানের গুলি চালাতে লাগলেন। একে একে স্পীড বোড গুলিকে টার্গেট করে অসীম সাহসে একাই হামলা চালালেন তিনি। তার আক্রমনে প্রত্যেকটি স্পিড বোড পানিতে ডুবে গেলো। মুন্সি আব্বুর রউফের দক্ষতায় ভীত হয়ে মেশিন গানের রেঞ্জের বাইরে পালিয়ে গেলো অবশিষ্ট লঞ্চ দুটি। তারা সেখান থেকে মর্টার শেলের গোলা বর্ষণ করতে লাগলো একমাত্র মেশিন গানের দিকে। হঠাৎ মর্টারের আঘাতে আব্দুর রউফের হেদ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেলো। নিথর হয়ে গেলেন আব্দুর রউফ। ততক্ষনে ৭ টি স্পীড বোড ডুবিয়ে নিজ সঙ্গীদের নিরাপদ প্রস্তান নিশ্চিত হয়ে গেছে। নিজের জীবনের বিনিময়ে রক্ষা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন! অন্যদিকে পথ চেয়ে চোখ শুকিয়ে গেলো আব্দুর রউফের মা মকিদুন্নেসার। কান্নার বাঁধ ভাঙ্গলো ছোট বোনের। এলোনা রউফ, আসলো না রঙ্গীন শাড়ি। বিনিময়ে আজকের ১৬ কোটি মানুষের জীবন হল নিরাপদ, পুস্পকোমল! সে সময় রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজারে কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারের পাশে আব্দুর রউফকে কবরস্থ করা হয়৷ যদিও ১৯৯৬ সালের আগে খোদ রাঙামাটি বাসীরাও জানতেন না আব্দুর রউফের কবরের ঠিকানা। ১৯৯৬ সালে রাঙামাটিবাসী প্রথম জানতে পারে, এ চিরসবুজ পাহাড়ের মাঝেই ঘুমিয়ে আছেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ৷ ঐ সময় দয়ালন চন্দ্র চাকমা নামে এক উপজাতীয় ব্যাক্তি বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের কবরটি শনাক্ত করেন৷ এরপর তাঁর কবরটিকে সরকার নতুনভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়৷ বাংলাদেশ আজকের অবস্থানে আসার পেছনে এই বীর শ্রেষ্ঠদের জীবন একেকটি খুটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার এত বছর পর এসে জাতিগত ভাবে আমরা লজ্জিত হই যখন আমাদের তরুন সমাজ এই জাতীয় খুটির নাম, পরিচয়, ইতিহাস মনে রাখনা। জানার আগ্রহ দেখায়না!
সূত্রঃ স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা,
বীরশ্রেষ্ঠ,
স্বাধীনতা যুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা,
মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধূরী গবেষনা।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.