স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ দের কথা- ৫ (বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন)
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে যারা বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মাঝে কেউ ছিলেন বাঘের মত স্থলচারী, কেউ ইগলের মত আকাশ রক্ষক আবার কেউবা ছিলেন জলচর তিমির মত বিপুল হিম্মতের অধিকারী। বাঙ্গালীর এই তিমির নাম ছিলো মোহাম্মাদ রুহুল আমিন। পানিতে ঝাপটা মেরে পাথি দিয়ে শাসন করা যার স্বভাবশুদ্ধ কাজ।
পানিতে নামলে তাকে একবাক্যে জলরাজ বলে মেনে নিতে কারো কোন দ্বিধা থাকতো না। পানিজয়ী এই বীরশ্রেষ্ঠ জন্মগ্রহন করেছিলেন নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার বাগপাদুরা গ্রামে ১৯৩৪ সালে। রুহুল আমিনের বাবা আজহার পাটোয়ারী। মায়ের নাম জোলেখা খাতুন। তাঁদের পরিবারটি ছিল সচ্ছল গৃহস্থ পরিবার। রুহুল আমিন তাঁদের প্রথম সন্তান। সাত ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সকলের কাছেই তিনি ছিলেন প্রিয়পাত্র।
দীর্ঘদেহী, সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকার হওয়ার ফলে অনেকের মধ্য থেকে তাঁকে চেনা যেত। ধীরে ধীরে ভাই বোন বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে পরিবার বড় হতে থাকায় অভাব নেমে আসে পরিবারে। মোট ৬ ভাই বোনের বিশাল সংসারের দায় নিতে পড়াশুনা বেশি দূর আর চালিয়ে যাননি মেধাবী রুহুল আমিন। ফলে ১৯৫৩ সালে এসএসসি পাশ করে যোগ দেন পাকিস্তান নৌ বাহিনীতে। জুনিয়র ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যুক্ত হবার পর ১৯৫৮ সালে তার পেশাগত প্রশিক্ষন সমাপ্ত হয়। এরপর পদোন্নতি হয় ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার হিসেবে।
প্রশিক্ষনকালীন সময়ে পাকিস্তানের নানা প্রশিক্ষন শিবির ও জাহাজে প্রশিক্ষন সমাপ্ত করে মূল কর্মজীবনের শুরুতে ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রামে বদলী হয়ে আসেন। সেখানে দ্বায়িত্বপালনের মাঝেই ১৯৭১ এর বিভীষিকা অন্য সবার মত তাকেও দারুন ভাবে ক্ষুব্ধ করে তোলে। তিনি বুঝতে পারেন যুদ্ধই শেষ পরিনতি, যুদ্ধই বাঙ্গালীর মুক্তি দরজা। ফলে মানসিক ভাবে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে নেন নৌ বাহিনী ছেড়ে পালানোর। সে সময় বাঙ্গালী সৈনিক মাত্রই চূড়ান্ত সন্দেহের তালিকায়। তাই ঘাটি ছাড়া চাট্টিখানি কোন কথা নয়! চারিদিকে বিপুল প্রহরা। এর মাঝেই একদিন ধুর্ত রুহুল আমিন সকল ন্রাপত্তা চোখ ফাঁকি দিয়ে মুক্ত স্বাধীন হয়ে বেরিয়ে এলেন। সেখান থেকে সরাসরি চলে গেলেন সীমান্ত পথে ত্রিপুরা রাজ্যে, মুক্তিবাহিনীর সাথে যুক্ত হতে। সেখানে গিয়ে সেক্টর কমান্ডার শফিউল্লার সাথে ২ নাম্বার সেক্টরে যুক্ত হলেন।
শুরু হল স্থল পথের সম্মুখ লড়াই অভিজ্ঞতা। পানির রাজা ডাঙ্গায় এসে বিভিন্ন স্থানে অপারেশন চালান সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলে মুক্তির সর্বাধিনায়ক ওসমানির নির্দেশে রুহুল আমিন যুক্ত হন বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে। তখন কলকাতা বন্দরের দুটি টাগ বোটকে গানবোটে রুপ দিয়ে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীকে উপহার দেয় ভারতীয় সরকার। পলাশ ও পদ্মা নাম দিয়ে বাংলাদেশে অপারেশনে পাঠানো হয় জাহাজ দুটিকে। রুহুল আমিন পলাশ গানবোটের ইঞ্জিন রুপে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালের ৬ই ডিসেম্বর মুক্তি বাহিনী অসীম বীরত্বে দখল করে নেয় যশোর ক্যান্টনমেন্ট। ফলে মংলা বন্দরের নিয়ন্ত্রন গ্রহন একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়ে। মংলা ঘেষা তিতুমির ঘাটি তখন পাক বাহিনীর নিয়ন্ত্রনে। ফলে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীতে স্বীদ্ধনাত হল খুলনা অপারেশনের। সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ভারতীয় কমান্ডারের নেতৃত্বে পদ্মা, পলাশ ও ভারতীয় পানভেল গানবোট বাংলাদেশে প্রবেশ করলো।
হিরন পয়েন্ট পর্যন্ত সম্পূর্ণ বাধাহীন ভাবে প্রবশ করে ১০ ডিসেম্বর ভোর ৪ টায় রওনা হয় মংলার দিকে। মূল অভিজান শুরুর পর রুপসা শিপ ইয়ার্ড পার হয়ে মংলা ফেরি ঘাটের কাছে পৌছে গেলো তিনটি গানবোট। সময় ঠিক দুপুর ১২ টা। এই সময়েই আকাশে অনেক উচুতে ৩ টি জঙ্গি বিমান দেখা গেলো। সকলেই বিমান ভূপাতিত করার জন্য প্রস্তুতি নিতে পাগলে ভারতীয় কমান্ড থেকে বলা হল সমস্যা নেই। বিমান গুলো ভারতীয় বিমান বাহিনীর। ফলে সকলেই যে যার কাজে ফিরে গেলো। ঠিক সে সময় হঠাত করেই বিমান গুলো খুব নিচ দিয়ে চলতে গিয়ে বোমা বর্ষণ শুরু করলো গানবোট গুলোর ওপর। অথচ ভারতীয় বিমান বাহিনীর সাথে কথা বলে প্রত্যেকটি গানবোটের ওপর হলুদ রং করে সেগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছিলো।
ভারতীয় বিমান বাহিনী থেকেও ঐ এলাকায় বোমা বর্ষনে নিষেধাজ্ঞা ছিলো! তবুও উতি উৎসাহী ভারতীয় কিছু বৈমানিক মুহুর্মুহু আক্রমন চালাতে লাগলো মুক্তি বাহিনীর নৌ শক্তির ওপর। পদ্মা পুরোপুরি আক্রান্ত হয়ে গেলো। বহু নাবিক হতাহত। ইঞ্জিন রুম জ্বলছে! এবার শুরু হল বাক বিতন্ডা। একপক্ষ রুহুল আমিনের নেতৃত্বে হানাদার ভারতীয় বিমানে পাল্টা আক্রমণের পক্ষে। অন্যদল পলাশের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রায় চৌধুরীর কথায় নির্বাগ। অধিনায়ক সকলকে গানবোট ত্যাগ করে পানিতে ঝাপ দিতে বললে বাঘের মত ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলেন রুহুল আমিন। নিজেই সকলকে হানাদার বিমানের ওপর আক্রমন চালাতে নির্দেশ দিয়ে ফিরে এলেন ইঞ্জিন রুমে। কিন্তু অধিনায়কের কথায় সকলেই নিস্ক্রিয়তা অবলম্বন করলে পরবর্তী বোমা এসে পড়লো পলাশের ওপর। মুহুর্তেই জোয়ান দেহগুলো রক্তে রোঞ্জিত হয়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। রুহুল আমিনের বাম হাত উঠে গেলো। তবুও প্রচন্ড আহত অবস্থাতেই নদী সাঁতরে পাড়ে চলে এলেন রুহুল আমিন।
সেখানে অপেক্ষায় আছে আরেক শত্রু। রাজাকার বাহিনী! আহত রুহুল আমিনকে ঐ অবস্থায় ধরে বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে লাশ ফেলে চলে যায় তারা। কয়েকদিন সেই লাশ নদীর পাড়ে পোঁচে যায়! অবশেষে স্থানীয় বাঙ্গালীরা এই বীরের দেহকে সমাহিত করেন। এই অসম সাহসী বীরের শবদেহ সমাহিত করা হয় খুলনার রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামে রূপসা নদীর তীরে। তাঁর কবরটি আজও তাঁর বীরত্বের শক্তি ও শোককে বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপসা ফেরিঘাটের লুকপুরে। রুহুল আমিনের গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে আমিন নগর। সেখানে পারিবারিক দানকৃত জমিতে সরকার নির্মান করেছে রুহুল আমিন স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার। পানির তিমি বীর শ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন জীবন দিয়ে দেশের রক্ষক হয়েছেন। আর আজও তার স্মৃতির পাঠাগার জ্ঞান বিতরন করে আলো জ্বালিয়ে যাচ্ছে দেশের প্রান্তরে প্রান্তরে।
এই মহান সেনানীর উদ্দেশ্যে সবসময় বাঙ্গালীর অকৃত্রিম দোয়া ও সম্মান। মহান আল্লাহ এই শহীদকে ভালো রাখুন।
সূত্রঃ স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা,
বীরশ্রেষ্ঠ,
স্বাধীনতা যুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা,
মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধূরী গবেষনা।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.