স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ দের কথা- ৪ (বীর শ্রেষ্ঠ সিপাহী মোহাম্মাদ হামিদুর রহমান)
দেশের অন্তিম মুহুর্তে কিছু প্রাণ কল্পনাতীত চঞ্চল হয়ে ওঠে। এদের স্থান কোন পরিবার কিংবা এলাকায় সিমাবদ্ধ থাকেনা। দেশ থেকে দেশান্তরে সকল পরিবারের একান্ত সন্তান হয়ে ওঠেন তারা। বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মাহ হামিদুর রহমান ছিলেন তেমনই এক প্রাণ। মাত্র ১৮ বছর বয়সে পুরো বাংলাদেশের ভার বহনে অসীম সহযোগীর ভূমিকা রেখেছিলো এই সদ্য তরুন প্রাণ।
শাহাদাতের পর ত্রিপুরার একটি পরিবারের পারিবারিক করস্থানে তাকে কবরস্থ করতে পেরে ধন্য হয়েছিলো ঐ পরিবার। পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার চাপড়া থানার ডুমুরিয়া গ্রামে ১৯৪৫ সালে মোহাম্মাদ হামিদুর রহমানের জন্ম। ভারত ভাগের পর তাঁদের পরিবার তৎকালীন খুলনা জেলার খালিশপুরের ঘরোদায় বসবাস শুরু করেন। তিনি খালিশপুরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। এরপর স্থানীয় একটি নাইট স্কুলে পড়াশুনা করেন। অল্প বয়সেই যুক্ত হন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে।
১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেয়ার মাধ্যমে শুরু হয় স্বল্পকালীন সেনাজীবন। হামিদুর রহমানের সেনাজীবন পর্যালোচনা করলে অবাক হতে হয়। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার প্রস্তুতির জন্যই যেন পাকিস্তানি বাহিনীর সামরিক কৌশল রপ্ত করতে গিয়েছিলেন তিনি! তা না হলে যুদ্ধের মাত্রা কয়েক মাস আগে কেন সেনা বাহিনীতে যুক্ত হবেন? আর তিনিই কিনা হানাদার পাক বাহিনীতে ধ্বস নামাবেন! ২৫ মার্চের কালো রাত। ঐটিই হামিদুর রহমানের জীবনের সবচেয়ে কঠিন স্বীদ্ধনাত নেয়ার রাত।
২০ বেলুচী রেজিমেন্টের সেনারা ইবিআরসির বাঙ্গালী সেনাদের ওপর আক্রমণ করেছে! তীব্র প্রতীরোধ করে যে সকল বাঙ্গালী সেনা সম্মুখে ছিলেন তাদের মাঝে হামিদুর রহমান অন্যতম। ফলে বেলুচ বাহিনীকে পরাস্ত করে পাক সেনা বাহিনী থেকে সফল ভাবে পালিয়ে আসতে পেরেছিলেন তারা। ঐ রাতে ইবিআরসির কয়েক হাজার বাঙ্গালী সদস্যকে হত্যা করেছিলো বর্বর ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের সেনারা। ঐ রাতেই হামিদুর রহমান যুক্ত হন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে।
পরিবারের সাথে শেষ দেখা করতে যান গ্রামের বাড়িতে। মাত্র এক রাত থেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। বিদায়ের মুহুর্তে মা কে বলে আসেন যেকোন কিছুর বিনিময়ে দেশকে মুক্ত করে তবেই বাড়ি ফিরবেন। মায়ের অশেষ দোয়া মাথায় নিয়ে মুক্তিসংগ্রামে যোগ দিতে ৩০ মার্চ চলে আসেন যশোরের ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধাদের দলে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে প্রথমে রান্নার দ্বায়িত্ব দেয়া হয়। হামিদুর সমর যুদ্ধে যুক্ত হবার প্রবল ইচ্ছা প্রকাশ করলে কোদালকাঠি যুদ্ধে প্রেরন করা হয়। সেখানে অসামান্য বীরত্ব দেখানোর পর হামিদুর সমর যুদ্ধে একজন অপরিহার্য যোদ্ধা হিসেবে পরিগতি হতে লাগলেন।
অক্টোবর মাসের শেষভাগে হামিদুর রহমান ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সি কোম্পানির হয়ে ধলই সীমান্তের ফাঁড়ি দখল করার অভিযানে অংশ নেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সীমান্ত ঘাটি দখলের স্বীদ্ধাত হয়। মাত্র ৪০০ গজ দূরেই ভরতীয় সীমান্ত। অথচ এখানেই একটি চা বাগান দখল করে রীতিমত বাঙ্কার খনন করে শক্ত অবস্থান গ্রহন করেছে হানাদার পাক বাহিনী। ২৪ মার্চ থেকে শুরু হয় সংঘর্ষ। প্রচন্ড সেই সংঘর্ষ গড়ায় ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যা পর্যন্ত। কোন পক্ষই নিশ্চিত নয় যুদ্ধ কোন দিকে গড়াবে? ২৮ অক্টোবর তারিখের আগের রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল শুরু করলো সম্মুখ যাত্রা। অত্যন্ত সন্তর্পনে এগিয়ে চলছে সে বাহিনী। উদ্দেশ্য- ঐ রাতেই পাক হানাদারদের ঘাটিটি গুঁড়িয়ে দেয়া। ল্যাফটেন্যান্ট কাইয়ুমের নেতৃত্বে ১২৫ জন যোদ্ধা মোট তিন প্লাটুনে ভাগ হয়ে এগিয়ে চলছে।
সামনে দুই প্লাটুন আর পেছনে এক প্লাটুন মুক্তিফৌজ। হঠাত সামনের সারির এক মুক্তিযোদ্ধার পায়ের আঘাতে মাটিতে পুতে রাখা পাক বাহিনীর মাইন বিদফোরিত হয়। মুহুর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন কয়েকজন সম্মুখ যোদ্ধা। রাতের নিরবতা ভেঙ্গে নতুন এই পরিস্থিতিতে পাক বাহিনী চূড়ান্ত ভাবে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। এমন পরিস্থিতেও মুক্তিযোদ্ধারা মোটেই দমে গেলেন না। সেখানেই তারা নানা পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে পাল্টা গুলি চালাতে শুরু করলেন।
শুরু হল তুমুল লড়াই। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি মেশিনগানের গুলি খুব সমস্যার সৃষ্টি করছিলো। আড়াল থেকে ঐ মেশিনগানের গুলি মুক্তি বাহিনীকে সম্মুখে অগ্রসর হতে দিচ্ছিলোনা। ফাঁড়ির দক্ষিন-পশ্চিম থেকে আসছিলো অবিরত গুলি। ফলে ঐ মেশিনগানকে বন্ধ করে দেয়া অপরিহার্য। স্বীদ্ধান্ত হয় এই পয়েন্টে গ্রেনেড হামলা করতে হবে। যথারীতি সাহসী এই দ্বায়িত্ব এসে পড়ে হামিদুরের জন্য। হাসিমুখে সঙ্গীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পার্শ্ববর্তী নিচু খাল এলাকা দিয়ে হামাগুড়ির সাহায্যে গান পয়েন্টের পেছনে পৌছে যান হামিদুর। মাইনের ঝুকি মাথায় নিয়ে এ কাজটি সফল ভাবে করার ক্ষমতা যে হামিদুরের ছিলো! হামিদুর দেখলে তার সামনেই ২ হানাদার অবিরাম মেশিন গান থেকে গুলি করে যাচ্ছে তার সঙ্গীদের দিকে।
আর মুহুর্ত বিলম্ব না করে ঝাপি পড়লেন হামিদুর। ২ পাকিস্থানি হানাদারকে পরাস্ত করে নিজের কাছে থাকা ছুরি দিয়ে হত্যা করলেন তাদেরকে। অন্যদিকে শত্রুদের ছোড়া গুলিতে হামিদুরের প্রাণ বেরিয়ে গেলো। থেমে গেলো মেশিন গান। মুক্তিযোদ্ধারা অতিদ্রুত দখল করে ফেললেন ঐ ঘাটি। পরাজিত হল পাকিস্তানের শক্তিশালী ৩০/এ ফ্রটিয়ার রেজিমেন্ট। সহযোদ্ধারা দ্রুত হামিদুরের কাছে এগিয়ে এলেন। ততক্ষনে হামিদুর চলে গেছেন শ্রষ্টার কাছে। দিয়ে গেছেন অনন্য উপহার, অনন্য বিরত্ব।
এই বীরের লাশ দেখে হতবাক হয়ে যান সহযোদ্ধারা। মুহুর্তেই শ্রধা আর ভক্তিতে নুয়ে পড়েন তারা। দ্রুত লাশ গ্রহন করে সীমান্ত পেরিয়ে ত্রিপুরায় প্রবেশ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। সেখানে হাতমছড়া গ্রামে এক গ্রামীন পরিবারের পারিবারিক কবরস্থানে পরম মমতায় দাফন করা হয় হামিদুরের দেশকে। হামিদুর তার ১৮ বছরের জীবনকে এত মূল্যবান করে গেলেন যে সীমান্ত পেরিয়ে অপামর সাধারন্যের পারিবারিক মেহমান হয়ে গেলেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার তার দেহ স্বদেশে এনে শহীদ বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধায় দাফন করে। হামিদুর ছিলেন বাংলাদেশের খুটি। অনাগত হামিদুর সৃষ্টি লক্ষ্যে তার ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেরনা স্বমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় লাইব্রেরী ও স্মৃতিস্তম্ভ। যতদিন বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে থাকবে, ততদিন জ্ঞানের আলো বিতরন করে যাবে হামিদুর রহমানের পাঠাগার।
সূত্রঃ স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা,
বীরশ্রেষ্ঠ,
স্বাধীনতা যুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা,
মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধূরী গবেষনা।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.