স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ দের কথা- ৩
মুক্ত বৈমানিক বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে সকল বীরশ্রেষ্ঠ জীবন দিয়েছেন তাদের প্রত্যেকের ঘটনা গুলোই অত্যন্ত রোমহর্ষক। যদিও তাদের মাঝে বীর শ্রেষ্ঠ মতিউরের ত্যাগের ঘটনাটি ছিলো আরো বেশি চমকপ্রদ।
১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান পুরান ঢাকার ১০৯ আগা সাদেক রোডের পৈত্রিক বাড়ি "মোবারক লজ"-এ জন্মগ্রহণ করেন। মা সৈয়দা মোবারুকুন্নেসা৷ বাবা মৌলবি আব্দুস সামাদ৷ তিনি পেশায় ছিলেন ঢাকা কালেক্টর অফিসের সুপার৷ নরসিংদী জেলার রায়পুর থানার রামনগর গ্রামে ছিল তাঁদের পৈত্রিক নিবাস৷ নয় ছেলে দুই মেয়ের পরিবারে জন্ম নেয়া মতিউর ছিলেন। ১৯৫২ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় ৷ ১৯৬০ সালের মে মাসে মতিউর কৃতিত্বের সাথে ১ম বিভাগে মেট্রিক পাস করলেন ডিস্টিংশনসহ৷ এরপর ১৯৬১ সালের আগস্টের ১৫ তারিখে তিনি রিসালপুরে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর একাডেমিতে ফ্লাইট ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন জিডি পাইলট কোর্সে৷ মতিউ ছিলেন প্রচন্ড উচ্চাকাংকাংখী ও পরিশ্রমী। অল্প দিনেই ১৯৬৭ সালে তিনি ফ্লাইট লেফটেনেন্ট পদে উচ্চাসীন হন।
তখন এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে মিলি খানকে বিয়ে করে পাকিস্তান চলে যান। ১৯৭১ সালে দেশের অবস্থা যখন প্রচন্ড খারাপ ঠিক তখন বার্ষিক ছুটি কাটাতে স্বপরিবারে আসেন বাংলাদেশে। তখন জানুয়ারী মাস। দেশে এসে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতা প্রত্যক্ষ করে মতিউর নিজে একজন পাকিস্তানি বাহিনীর কর্মকর্তা হয়েও অসীম সাহস আর ঝুকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন দেয়ার উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষন শিবির গড়ে তোলেন।
একই সাথে নরসিংসীর নিজ গ্রামে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে যুবকদের মাঝে কাজ শুরু করেন তিনি। এর মাঝেই একদিন পাকিস্তানি সামরিক বিমান এসে মতিউরের প্রশিখন শিবিরে বোমাবর্ষণ করে যায়। যদিও আগ থেকেই এমন আশংকায় মতিউর সহ প্রশিক্ষনার্থী মুক্তিযোদ্ধারা অন্যত্র সরে পড়তে পেরেছিলেন। এ ঘটনার পর মতিউর একটি বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের আশায় যঠিক সময়ে পাকিস্তান ফেরত না গেলেও শুধু মাত্র দেশের জন্য একটি যুদ্ধ বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনায় ফিরে যান পাকিস্তানে। দিনটি ছিলো ১৯৭১ সালের ৯ মে। এদিন তাকে ফ্লাইং সেফটি অফিসারের দ্বায়িত্ব প্রদান করা হয়।
এদিন রশিদ মিনহাজ নামের এক পাঞ্জাবী প্রশিক্ষনার্থী টী-৩৩ বিমান নিয়ে প্রশহিক্ষণ উড্ডয়নে যাচ্ছিলো। রানওয়ের সামনে গিয়ে সেফটি অফিসার মতিউর তার ছাত্রকে ইশারা করে থামতে বলেন। বিমানটি তখন একটি ছোট্ট পাহাড়ের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা যাচ্ছিলোনা সেটি। মতিউর বুঝাচ্ছিলেন বিমানের পেছনে একটি সমস্যা হয়েছে তাই তার দেখতে হবে। মিনহাজ কিছু না বুঝে বিমানটি থামালে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মতিউর বিমানের ঢাকনা দিয়ে মিনহাজের নাকে ক্লোরোফর্মের রুমাল চেপে ধরেন।
এ সময় অনুচ্চারিত সামান্য শবে কল্ট্রোল টাওয়ারে সিগনাল পাঠিয়ে দেন মিনজাহ। মিনজাহ ও তার বিমানটি হাইজযাক হচ্ছে এমন সিগনাল পেয়ে ৪ টি জঙ্গি বিমান নিয়ে মতিউরের পেছন নেয় পাকিস্তানিরা। মতিউর এসময় খুব নিচ দিয়ে বিমকান পরিচালনা করছিলেন। পাকিস্তানিরা মতিউরকে ধরতে না পারলেও একসময় পাঞ্জাবি শিক্ষার্থী মিজহাজের জ্ঞাণ ফিরে আসে। ফলে মিনহাজ ও মতিউর বিমানের ভেতরেই ধস্তা ধস্তি শুরু করেন। এসই মাঝে হঠাট বহির্গমন সুইচ চেপে ধরে মিনজাহ। ফলে বিমান থেকে সোজা নিচের দিকে পড়ে যান মতিউর রহমান। আর বেসামাল বিমান সহ একটি পাহাড়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে মারা যায় মিনহাজ। পাকিস্তানিরা ঐ ধংসপ্রাপ্ত বিমানটিকে ভারতীয় সীমান্তের মাত্র ৩৫ কিলোমিটার পূর্ব থেকে উদ্ধার করে।
সে সময় মতিউরকে একটি চতূর্থশ্রেণীর কবরস্থানে কবরস্থ করে পাকিস্তানিরা। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের পর ২০০৬ সালের ২৩ জুন তারিখে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের হেদাবশেষ নিয়ে আসা হয় বাংলাদেশে। ২৫ তারিখে যথাযথ মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয় মীরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে শহীদ মতিউর রহমান ছিলেন চিরো মুক্ত ইগল! যতদিন বাংলাদেশ থাকতে ততদিনই বেঁচে থাকবেন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান।
সূত্রঃ স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা,
বীরশ্রেষ্ঠ,
স্বাধীনতা যুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা,
মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধূরী গবেষনা।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.