এপ্রিল ফুল নিয়ে কল্পিত গল্প...
এই শতাব্দির শুরুর দিকের ঘটনা। ইনকিলাব, দৈনিক দিনকাল, সংগ্রাম ইত্যাদি পত্রপত্রিকায় হুট করেই বড়-বড় কলাম লেখা হতে থাকলো, এপ্রিল ফুল মূলত মুসলমানদের উপর অত্যাচারের এক ঐতিহাসিক নিদর্শন, যার মাধ্যমে মুসলমানদের পরাজয়কে ফুটিয়ে তুলে ব্যাঙ্গবিদ্রুপ করা হয়। যাচ্চলে, এতোদিনের ফাইজলামী প্র্যাক্টিসের তলে তাইলে এইসব! মানুষ খুন করে বিশ্বব্যাপী ফাইজলামী! এপ্রিল ফুলের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জ্ঞ্যাপনে মত্ত সবাই। আমরাও এপ্রিল ফুল ভুলে গেলাম, কথা-প্রসঙ্গে কখনও দরকার হলে ধর্মীয় আবেগের পাশাপাশি অপসংস্কৃতি তথা পুজীবাদী বিশ্বের চাপিয়ে দেয়া উৎসব হিসেবে গণ্য করে লেকচার মারা শুরু করলাম। এ সমস্ত তথ্য বাঙালির কুটি-কুটি ডায়ালেক্টিক তথ্যেভান্ডারে যুক্ত হলো, যেমন বাঙালি মুসলমানের আরো অসংখ্য ডায়ালেক্টিক তথ্য, গীতাঞ্জলি রবীন্দ্রনাথ লিখেননি, নজরুল লিখেছিলেন, জমিদারপুত্র রবীন্দ্রনাথ জোর খাটিয়ে পান্ডুলিপি চুরি করে নোবেল কামিয়ে নিয়েছেন, লাল পিপড়া হিন্দু আর কালো পিপড়া মুসলমান, সুপারী, ডাব, খেজুর ইত্যাদি পাম ট্রি ঝড়ো বাতাসে রুকুর মতো আকৃতি ধারণ করে তাই উহারা মুসলিম গাছ, আর তুলসী, হরতকী ইত্যাদি হিন্দু গাছ, নীল আর্মস্ট্রং চন্দ্রাভিযানের পর মুসলমান হয়ে গেছেন, নাসা এস্ট্রোনট সুনীতা মুসলমান হয়ে গেছেন ইত্যাদি।
কিন্তু কিছুটা বড় হয়ে এপ্রিল ফুলের ব্যাপারে এসমস্ত তথ্যে খটকা লাগা শুরু হলো। মানবজাতির এতোটাই জঘন্য অবস্থা যে কোন গোষ্ঠীকে মদজিদে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে মেরে সেটা কৌতুককর উৎসব ঘোষণা করবে, আবার সেই উৎসব এই আধুনিক যুগেও স্বমহীমায় বলবৎ থাকবে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত শক্তি জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমাণবিক হামলা নিয়ে তো প্রতি-বছর বিশ্বব্যাপী শোক পালন করা হয়! আর স্পেনে নিহত হতভাগ্য মুসলিমদের নিয়ে ফাইজলামী!
খুঁজে দেখলাম ইতিহাস, উক্ত প্রসঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে যা পেলাম তার নাম ঘোড়ার আন্ডা! এপ্রিল ফুল মোটেই কোন হত্যাজজ্ঞের সাক্ষ্য নয়, নয় কোন দুখঃজনক ইতিহাসের কৌতুককর ফল। তবে এপ্রিল ফুলের সত্যিকারে উৎসটা নিয়ে ইতিহাসবেত্তাদের মাঝে মতভেদ আছে। উৎসগুলি একটু ঘেটে দেখা যাক - - -
প্রাচীন ইউরোপের সকল উৎসব বসন্ত কেন্দ্রিক ছিল। এপ্রিল-ফুলের উৎপত্তি মূলত সেসব উৎসব নির্ভর, কোন ট্র্যাজেডি নির্ভর নয়। ফার্সি(Persian) ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নতুন বছরের(নৌরোজ) ১৩তম দিনে প্রাচীন ইরানের লোকজন পরস্পরের সাথে হাসি-ঠাট্টা করত, সেটা খৃষ্টপূর্ব ৫৩৬ এর কথা। একে বলা হয় 'সিজদাহ বেদার', ফার্সি ক্যালেন্ডারের ১৩তম দিনটিই ইংরেজি ক্যালেন্ডারের এপ্রিল ১ বা ২ হয়ে থাকে। - তথ্যসূত্র - The History of April Fools' Day
গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসবিদদের মতে 'এপ্রিল ফুল' প্রথাটির শুরু হয় রোমান সম্রাট কনস্ট্যান্টাইনের (২৮৮-৩৩৭ খৃ.) শাসনামলে। হাসি-ঠাট্টায় মত্ত একদল বোকা গোপাল ভাঁড়েরা সম্রাটকে কৌতুক করে বলে, তারা রাজার চেয়ে ভালভাবে দেশ চালাতে পারবে। রাজা মহোদয় এতে বেশ কৌতুক বোধ করলেন, তিনি গোপাল ভাড়দের সর্দার কুগেল (Kugel)কে একদিনের জন্য বাদশাহ বানিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিলেন। কুগেল সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যময় আইন জারি করে দিল, প্রতিবছরের এইদিনে সবাই মিলে তামাশা করবে। অনেকের মতে প্রাচীন ওই সময়ের মারাত্মক দিনগুলোতে রাজাদের দরবারে বোকারুপীরাই ছিল প্রকৃত জ্ঞানী। তারা মজা বা হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে অনেক কাজ কৌশলে হাসিল করে নিত বা জ্ঞানের কথা রসালোভাবে চারদিকে ছড়িয়ে দিত। - তথ্যসূত্র - April Fools' Day: Origin and History
কোরিয়াতে পয়লা এপ্রিল ছিল 'বছরের প্রথম তুষারপাতের দিন', গুরুত্বপূর্ণ এক কোরিয়ান স্টেট 'জোসেন' এর ফাউন্ডার উচ্চবংশীয় জোসিয়নরা (১৩৯২ –১৮৯৭) এদিন উচ্চমর্যাদা ঝেড়ে ফেলে বরফের বল পরস্পরের দিকে ছুড়ে মেরে বোকা বানাতো পথচারীদের এবং ভুয়া অজুহাত দেখিয়ে হাস্যরস তৈরি করত, বিনিময়ে পথচারীরাও বরফের বল বানিয়ে ছুড়ে দিত। - তথ্যসূত্র - April Fools’ Day in Republic Of Korea
প্রাচীন রোমে ১ এপ্রিল নববর্ষ ছিলো, কিন্তু বাকি ইউরোপিয়ানরা সেটা পালন করত ২৫ মার্চ। ১৫৮২ সালে পোপ গ্রেগরি XIII পুরোনো জুলিয়ান ক্যালেন্ডারকে বাতিল করে নতুন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার(বর্তমানে প্রচলিত যাকে আমরা ইংরেজি ক্যালেন্ডার বলি) চালুর আদেশ দেন যেখানে ১ জানুয়ারি নববর্ষ। জনগণের বিরাট অংশ এই পরিবর্তনকে অগ্রাহ্য করে ১ এপ্রিল পালন করতে থাকে। পরিবর্তনবিমুখ সেসব সনাতন বিধিবদ্ধ মানুষদের নিয়ে কৌতুক করতে 'এপ্রিল ফুল'স ডে'র চল শুরু হয়। ১ জানুয়ারি নববর্ষ পালনকারীরা ১ এপ্রিলে পালনকারী সনাতনপন্থীদের ভূয়া উপহার পাঠিয়ে কৌতুকের জন্ম দিত। - তথ্যসূত্র - April Fools' Day: Origin and History
ফ্রান্সে পয়লা এপ্রিলে কাউকে বোকা বানালে বলা হতো 'এপ্রিল মাছ' (April fish), ফ্রেঞ্চ ভাষায় 'poisson d’avril'। এ নামকরণের ব্যাখায় বলা হয়, রাশিচক্র অনুযায়ী স্বর্গের কাল্পিক রেখা অতিক্রম করাকালে এপ্রিলে সূর্যকে মাছের মত দেখায়। এইদিনে তারা ছুটি কাটাত এবং মরা মাছ এনে তাদের বন্ধুদের পেছনে সেটে দিয়ে মজা করত। এখন মরা মাছের বদলে ছোটরা আসল মাছের স্টিকি কাগজ বন্ধুদের শার্টের পেছনে গেথে দেয়। ক্যান্ডি শপ ও বেকারিগুলোও মাছ আকৃতির মিষ্টি পরিবেশন করে এইদিন স্মরন করে। - তথ্যসূত্র - The History of April Fools' Day
স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ ১৫৭২ সালে নেদেরল্যান্ড শাসন করতেন। যেসমস্ত ডাচ সেই শাসন অমান্য করেছিলো তাদের বলা হয় 'গুইযেন'। ১৫৭২ এর পয়লা এপ্রিল গুইযেন বা বিদ্রোহীরা উপকুলীয় শহর 'Den Briel' দখল করে ফেলে, এ বিদ্রোহ মহীরুহ আকার ধারণ করলে স্প্যানিশ সেনা প্রধান বা 'দ্যা ডিউক অব অ্যালবা' বিদ্রোহ প্রতিরোধে ব্যর্থ হন। ডাচ শব্দ 'ব্রিয়েল' অর্থ হচ্ছে 'কাঁচ', পয়লা এপ্রিলে ডাচরা ঠাট্টা করে স্প্যানিশদের ‘অ্যালবা কাঁচ হারিয়েছে (Op 1 april verloor Alva zijn bril - On April 1st, Alva lost his glasses)’ বলে পূরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে থাকে। 'অ্যালবা' হলো স্পেনের শহরের নাম যেখানে দ্যা ডিউক অব অ্যালবার সদর দপ্তর ছিলো। - তথ্যসূত্র - Brielle
স্কটল্যান্ডে পয়লা এপ্রিল হচ্ছে 'কোকিল শিকারের দিন'। 'Hunting the Gowk or Cuckoo', Gowk মানে হচ্ছে বোকা ব্যাক্তি। স্কটিশে স্থানীয় স্লোগানটা ছিল "Dinna laugh, dinna smile. Hunt the gowk another mile." - তথ্যসূত্র - April Fools’ Day: Origins and history
বৃটেনে এপ্রিল ফুল নতুন রুপে জন্মলাভের পর এর নামকরন করা হয় এপ্রিল-কোকিল (April-gowks)। পূরা কাহিনীর সাথে এই দিনের যোগসূত্র স্থাপন করতে গিয়ে ১৩৯২ খ্রীষ্টাব্দে জিওফ্রি চোসার (Chaucer) এর The Nun’s Priest’s Tale গল্পের দুই বোকার ৩২ দিনে মাসের কাহিনী চলে আসে, ৩২ দিনের শুরুটি হল মার্চের ১ তারিখ, অর্থাৎ শেষদিন ১ এপ্রিল। সেই দুই বোকা হচ্ছে এক শিয়াল এবং এক মুরগী, শিয়াল বোকা বানিয়েছিলো মুরগীকে। - তথ্যসূত্র - The Nun's Priest's Tale
বসন্ত মানুষের মনে আনন্দ এনে দেয় তাই বসন্তের দিনগুলোতে পরস্পরের সাথে মজা করত মানুষ। বসন্তকালীন বিষুব সময়ে (vernal equinox), অর্থাৎ যে সময়ে দিনরাত মোটামুটি সমান থাকে। সময়টি হল ২১শে মার্চ থেকে ২৩শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ঋতু পরিবর্তনের প্রান্তিক সময় ২৫ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল । ইউরোপিয়ান অনেক সভ্যতায় এমন প্রমাণ পাওয়া যায় যেখানে ঠিক এই সময়ে বোকা বানিয়ে মজা করার উৎসবের প্রচলন ছিল, সে সময়ে এই উৎসব এপ্রিলের প্রথম দিনে শুরু হয়ে এক বা দুই সপ্তাহ চলত হাসি-ঠাট্টা। রোমানরা এথিসের পুনরুত্থানের আনন্দ পালন করত ২৫ মার্চ, সেদিনের নাম ছিল হিলারিয়া, কাছাকাছি সময়ে হিন্দুরা পালন করে হোলি, ইহুদীরা পুরিম। প্রত্যেকটা উৎসবকেই কৌতুককর বা আনন্দদায়ক বলা যাবে, স্বাস্থের জন্যে উপকারী বলা যাবে, এখানে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের উপস্থিতি কোথায় তা অনেক খুঁজেও পাওয়া যায়নি।
তাহলে স্প্যানিশ ক্রুসেড বা স্পেনের রানী ইসাবেলাকে নিয়ে যেসমস্ত ঘটনা-উপঘটনা উপস্থাপন করা হয় সেসব কি আদৌ সত্য না? স্পেনে মুসলিমদের উপর অত্যাচার হয়নি?
আজ্ঞে, হয়েছে, স্পেনের শেষ মুসলিম শাসক আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ XII (স্প্যানিশ নাম 'বোয়াব্দিল') রাণী ইসাবেলা-ফার্ডিনান্ডের কাছে দুর্ভীক্ষপিড়িত গ্রানাডা নিয়ে আত্মসমর্পন করেন ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি। আত্মসমর্পন পর্ব শান্তিপূর্ণ ছিল, রাণীর সহযোগী ভুবন বিখ্যাত ক্রিস্টোফার কলম্বাস এ অনুষ্ঠানে উপস্থত ছিলেন। এবং মোহাম্মদ XII এর সাথে রাণীর চুক্তি হয়েছিল স্পেনে বসবাসরত মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দানের, সে চুক্তি রক্ষিত হয়নি, আত্মসমর্পন পরবর্তী সময় থেকেই বিবিধ জুলুম প্রক্রিয়া শুরু হয়। কাটাকুটি মূলত শুরু হয় ১৫০৮ সালে যখন 'ইঙ্কুইজিশন' ঘোষণা করা হলো, মানে ইহুদী এবং মুসলমানদের হয় ক্যাথলিক হতে হবে নয়তো স্পেন ছাড়তে হবে।
ধর্মযুদ্ধ সর্বকালেই বিভৎস ছিল, অগভীর ধর্মীয় আবাগে আক্রান্ত হয়ে কত মানুষের বেঘোরে প্রাণ গেল এবং এখনও যাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। যাই হোক, এসবের সাথে এপ্রিল ফুলের কোনই সম্পর্ক নাই, মসজিদে আগুন লাগিয়ে হত্যা অতঃপর ফুল্স ডে পালন একটি কল্পিত মিথ্যাচার, । স্পেনের ঘটনা সবিস্তারে জানতে পড়ে দেখতে পারেন A History of Medieval Spain।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
মন্তব্য: ৪ টি